শেখ হাসিনার দিল্লি সফর ও অর্থনৈতিক কূটনীতি
বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো একটি দেশের অর্থনীতি এককভাবে এগিয়ে যাওয়া বা বিপাকে পড়া আর সম্ভব নয়। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে একথাও মানতে হবে যে, করোনা মহামারি আসার আগের হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিগুলোর একটি।
প্রথমে করোনাজনিত সরবরাহ চেইনের ভঙ্গুরতা এবং তার পরপরই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সেই সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফলে আমাদের সেই অতুলনীয় অগ্রযাত্রার গতিতে সাময়িক হলেও এক ধরনের ছেদ পড়েছে। বিশেষ করে আমদানি করা জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পণ্যের দাম বিপুল হারে বেড়ে গেছে।
বিজ্ঞাপন
এই কারণে আমাদের মূল্যস্ফীতির হারও বেশ বেড়েছে। তাই হয়তো এই বৈশ্বিক সংকট আমাদের অন্যদের তুলনায় বেশি হতাশ করছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সামষ্টিক অর্থনীতি মজবুত একটি অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে বলেই কিন্তু অন্য অধিকাংশ দেশের তুলনায় আমরা করোনা সংকট মোকাবিলায় বেশি সফল হয়েছি।
আরও পড়ুন : সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ সংকট
প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে উন্নত এবং উন্নয়নশীল অনেক দেশেই নতুন করে সংরক্ষণবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও জনতুষ্টিবাদি রাজনীতির প্রকোপ বাড়তে পারে। এতে পশ্চিমের বাজারের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো।
বর্তমান সঙ্কট শুরুর বহু আগে থেকেই আমরা বলছিলাম যে, বিশ্বের অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতার মঞ্চগুলোর তুলনায় (যেমন—ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আসিয়ান) দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্য সহযোগিতা তুলনামূলক অনেক কম।
এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আন্তবাণিজ্যের পুরো সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে না পারলে এই অর্থনীতিগুলোর টেকসই বিকাশ খুবই কঠিন। একটি উদাহরণ দিয়েই এর সত্যতা প্রমাণ করা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশ ভারতে কিছু পণ্য রপ্তানি করছে। কিন্তু ভারতের আমদানি বাজারের আরও এক শতাংশ যদি বাংলাদেশ থেকে করা হয়, তাতে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে চার গুণ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১২-১৩ বছর ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সময়োচিত নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের ধারা বজায় রেখেছেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ভারত, নেপাল ও ভুটানের তরফ থেকে এক্ষেত্রে বিশেষ ইতিবাচক মনোভাবও আমরা লক্ষ্য করছি। কিন্তু নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এই আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন : অর্থনৈতিক কল্যাণ বাড়বে প্রবৃদ্ধি ও সক্ষমতায়
অন্যদিকে নতুন ধরনের ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণে পশ্চিমের দেশগুলো ক্রমেই চীন ও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে উদ্যোগী হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমের বাজারে নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ফলে বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কট আমাদের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে তেমনি আমাদের সামনে নতুন কিছু সুযোগও উন্মোচিত হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন ছাড়াও ভারতের স্থলভাগের ওপর দিয়ে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির সুবিধার বিষয়ও সুরাহা হয়েছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে যে, আঞ্চলিক বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানো এবং পশ্চিমের নতুন নতুন বাজরের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া- এই দুই ক্ষেত্রেই বিচক্ষণ অর্থনৈতিক কূটনীতি আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
আর এখানেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব আমাদের শক্তির জায়গা। এই প্রেক্ষাপটে তার সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া ভারত সফর এবং আসন্ন নিউইয়র্ক সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই বছর আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে তার এই স্মার্ট অর্থনৈতিক কূটনীতির সাফল্য উদযাপনের আশা করছি।
প্রথমেই আসছি সদ্য শেষ হওয়া ভারত সফরের প্রসঙ্গে। দুই দেশেরই সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারতে এই সফর সফল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা সবসময়ই আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রীয় জায়গায় থাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতি হয়েছে। এবারের সফরও তার ব্যতিক্রম নয়। এবারে কুশিয়ারা নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আওতায় সেচের জন্য বাংলাদেশ ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করতে পারবে এই অভিন্ন নদী থেকে।
আরও পড়ুন : অর্থনীতি যখন উৎসবের অংশ
বাংলাদেশের অর্থনীতির রক্ষাকবচ যে কৃষি, তার জন্য এই স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়া আসলেই একটি বড় সুখবর। আর তারচেয়েও বড় আশা জাগানিয়া বিষয় হলো, দুই দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার যে মনোভাব আমরা বিগত বছর থেকে দেখে আসছি, এই স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ায় সেই পরম্পরা বজায় থাকল।
এই ধারাবাহিকতার কল্যাণে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ও এক সময় একটি মীমাংসায় পৌঁছাবে তা এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে এও আমরা জানি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে তিস্তার পানি সমস্যা সমাধান মুশকিলই বটে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন ছাড়াও ভারতের স্থলভাগের ওপর দিয়ে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির সুবিধার বিষয়ও সুরাহা হয়েছে।
এই বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলেছে। পাশাপাশি ভারতে বাংলাদেশের রেলকর্মীদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ রেলওয়ের আইটি সিস্টেমে ভারতের সহযোগিতার বিষয়েও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। আগে থেকেই আমাদের রেল যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ভারতের দেওয়া লাইন অফ ক্রেডিট রয়েছে। ফলে এই দুটি সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে রেল খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও জোরদার হলো।
এবারে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলোর কল্যাণে পারস্পরিক বাণিজ্য সহযোগিতার পথ তাই আরও সুগম হলো বলা যায়। তবে এক্ষেত্রে উভয় দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাস্তবায়নের গতি যে খুবই শ্লথ এই কথাও মানতে হবে।
আরও পড়ুন : সঞ্চয়পত্র : মুনাফা হ্রাস, সংকট ও বাস্তবতা
যথাসময়ে এগুলো কার্যকর করা গেলে ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এবং এগুলো আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।
এসবের পাশাপাশি জুডিশিয়াল কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং প্রসার ভারতী ও বিটিভির মধ্যে সম্প্রচার সহযোগিতার জন্য সমঝোতা হয়েছে। সার্বিক বিচারে বলা যায় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরের ফলে দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মাধ্যমে বিশ্ব সঙ্কটকালে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির সময়োচিত উদ্যোগ নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে অচিরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন নিউইয়র্ক সফরে। এবারের সফরে শুধু জাতিসংঘের নানা ফোরামে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট ও ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি তার অভিজ্ঞতা প্রসূত নীতি-নির্দেশনা দেবেন তাই নয়, প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও সুচিন্তিত পরামর্শ দেবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তারা চীন থেকে তাদের বিনিয়োগ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। এই বিনিয়োগের একটা অংশ বাংলাদেশে আকর্ষণের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
মনে রাখা চাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের পঞ্চাশ বছরের পূর্তির অনুষ্ঠানমালাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই বছরই। তাই মার্কিন নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তাদের সাথে আলাপ আলোচনায় উৎসাহী হবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় নিশ্চয় তাদেরও বাংলাদেশের বিনিয়োগে সুযোগ-সুবিধা ও এসব বিষয়ে নানা-মাত্রিক দিকনির্দেশনা দেবেন।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সংযুক্তি আরও কী করে বাড়ানো যায় সেসব দিকেও তিনি এবং তার সহকর্মী নীতিনির্ধারকেরা আলো ফেলতে পারেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সমিতি এবং বিভিন্ন সফল উদ্যোক্তাদের সাথে তাদের মার্কিন ‘কাউন্টার-পার্টদের’ আরও ফলপ্রসূ মতবিনিময়ের জন্য তিনি উৎসাহও দিতে পারেন।
ইতিমধ্যে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তারা চীন থেকে তাদের বিনিয়োগ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। এই বিনিয়োগের একটা অংশ বাংলাদেশে আকর্ষণের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
অবকাঠামো ঘাটতি দ্রুত পূরণ করে ভিয়েতনামের মতো চীন-ফেরৎ মার্কিন উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে টানার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। আর এমনিতেও বাংলাদেশে শিল্পোৎপাদনের খরচ অনেকটই কম। এই কারণে বাংলাদেশের সফল ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের (বিশেষ করে পোশাক ও চামড়া শিল্প) সাথে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যিক সংযোগ বাড়াতে চাইছেন।
আরও পড়ুন : সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
সম্প্রতি একটি জরিপ থেকে জানা গেছে যে, মার্কিন রিটেইল ব্যবসায়ীদের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি বলেছেন তারা চীন বা ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক সংগ্রহে বেশি উৎসাহী। এই উৎসাহ বাস্তবে রূপান্তরে যে ধরনের নীতি সহায়তা ও ‘স্মার্ট’ অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রয়োজন তার প্রতি প্রয়োজনীয় সমর্থন নিশ্চয় আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই সফরে দেবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সময়োচিত অর্থনৈতিক কূটনীতি সর্বত্রই অক্ষুণ্ন থাকুক সেটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা। সংকটে ঘাবড়ে না গিয়ে সুচিন্তিত গণবান্ধব উদ্যোগ নেওয়ার শিক্ষা তিনি বঙ্গবন্ধুর মানবিক ও রূপান্তরবাদী নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য থেকেই আত্মস্থ করেছেন।
সঙ্কটকালে কী করে ঘুরে দাঁড়াতে হয় সেই অনুভব তার পরিবারেই নিহিত আছে। নেতৃত্বের এই পরম্পরা আমাদের আশার ক্ষেত্র প্রসারিত করে চলেছে। দেশে এবং বিদেশে সংকট মোকাবিলায় আশা সঞ্চারী এই নেতৃত্বের স্পর্শ আরও বিস্তৃত হোক সেই কামনাই করছি।
ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর