ছবি : সংগৃহীত

করোনা মহামারির রেশ কাটতে না কাটতেই হানা দিচ্ছে একের পর এক ভাইরাস। আর করোনার রেশ যে কেটে গেছে তা-ই বা বলি কীভাবে? চীন-জাপানের মতো দেশগুলোতে এখনো প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছে লক্ষাধিক নতুন করোনা রোগী।

বাংলাদেশে যখন আমরা মনে করতে শুরু করেছিলাম যে, আমরা বোধহয় একটু স্বস্তিতেই আছি, তখন এখানেও হঠাৎই লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে বাড়তে শুরু করেছে করোনার ব্যারোমিটার। তার উপর আমাদের ঘাড়ে এসে উটকো ঝামেলা হিসেবে জেঁকে বসেছে ডেঙ্গু।

আমাদের মতো যারা ডেঙ্গুর বাড়তি ঝামেলায় নেই, তাদের অনেকেও কিন্তু অতটা ভালো নেই। এই যেমন ল্যাটিন আমেরিকা আর মার্কিন মুলুকে চোখ রাঙাচ্ছে মাঙ্কিপক্স। এরই মধ্যে কথা নেই বার্তা নেই কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছে টমেটো ফ্লু।

আরও পড়ুন : বঙ্গভ্যাক্স : স্বাস্থ্যখাতের গেমচেঞ্জার 

ঘরের পাশে ভারতে এর উৎপত্তি। এখনো ছড়ায়নি ভারতের বাইরে কোথাও। কিন্তু ভারত বলেই আমাদের শঙ্কাটাও একটু বেশি। চীনের উহান থেকে আসা করোনাভাইরাসই যখন ঠেকিয়ে রাখা যায়নি, তখন আমাদের তিন পাশে যে ভারতবর্ষ সেখান থেকে টমেটো ফ্লু তো এদেশে আসতেই পারে। নতুন এই রোগ নিয়ে আমাদের আগ্রহ আর উৎকণ্ঠা পৃথিবীর আর দু’চারটি দেশের চেয়ে একটু হলেও বেশি।

বই-পুস্তক আর অনলাইন থেকে যতদূর জানা যাচ্ছে, টমেটো ফ্লু একটি কক্সাকি এ১৬ ভাইরাস। এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সাধারণ সর্দি-জ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই জ্বর, অবসাদগ্রস্ততা, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।

টমেটো খেয়ে কারো টমেটো ফ্লু হয় না। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর শরীরে লাল ফোসকা পড়ে, অনেকটা মাঙ্কিপক্সের মতোই। এগুলো বড় হয়ে টমেটোর আকৃতি ধারণ করে...

থাকতে পারে বমি বা বমির ভাব আর গিরায়-গিরায় ব্যথাও। না, টমেটো খেয়ে কারো টমেটো ফ্লু হয় না। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর শরীরে লাল ফোসকা পড়ে, অনেকটা মাঙ্কিপক্সের মতোই। এগুলো বড় হয়ে টমেটোর আকৃতি ধারণ করে, যে কারণে এর নাম টমেটো ফ্লু।

ফোসকাগুলো সাধারণত খুব ব্যথা হয়। আপনাআপনি ভালো হয়ে যায় টমেটো ফ্লু। চিকিৎসা বলতে রোগীকে আলাদা করে রাখা, প্রচুর পানি খেতে দেওয়া আর প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা।

টমেটো ফ্লু; ছবি : সংগৃহীত

এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র শিশুরাই টমেটো ফ্লু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তবে বড়দের যে একেবারেই হয়নি তাও কিন্তু নয়। বড়দের মধ্যে যারা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সবারই অবশ্য কোনো না কোনো কারণেই ইমিউন সাপ্রেশন ছিল।

এমনিতে টমেটো ফ্লু খুবই সংক্রামক। এর বিস্তার ঠেকাতে হলে রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত রোগীকে আলাদা রাখতে হবে। এছাড়াও রোগীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন, কাপড়চোপড়, থালাবাসন, খেলনা ইত্যাদি আলাদা করে ফেলতে হবে।

আরও পড়ুন : সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন কেন জরুরি

টমেটো ফ্লু’র প্রথম শনাক্ত হয় ২০২২ সালের ৬ মে ভারতের কেরালা রাজ্যের কোল্লাম জেলায়। এই পর্যন্ত এখানে ৮০ জনের ও বেশি শিশু আক্রান্ত হয়েছে।

এছাড়াও কেরালার আনচাল, আরিয়ানকাবু এবং নেদুভাথুর এলাকাগুলোয় পরবর্তী সময় টমেটো ফ্লু রোগী পাওয়া গেছে। কেরেলার বাইরেও ভারতের উড়িষ্যা এবং তামিলনাড়ু রাজ্যেও টমেটো ফ্লু’র রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে এই পর্যন্তই।

এমনিতে টমেটো ফ্লু খুবই সংক্রামক। এর বিস্তার ঠেকাতে হলে রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত রোগীকে আলাদা রাখতে হবে।

এই তিনটি রাজ্যের বাইরে ভারতের কোথায় আর ভারতের বাইরে পৃথিবীর অন্য কোথায়ও এখনো টমেটো ফ্লুর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাহলে কেন এই এক টমেটো ফ্লু নিয়ে এত মাতামাতি অথবা এই লেখাটিরই বা অবতারণা কেন?

অনেকেই মনে করেন, টমেটো ফ্লু চিকুনগুনিয়ার একটি ভ্যারিয়েন্ট। তেমনি আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আছেন, যাদের ধারণা এর সাথে যোগাযোগ আছে হ্যান্ড-ফুট-মাউথ সিনড্রোমের।

তবে যাই হোক আর নাই হোক, জ্বরের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা ইদানীং যখন মাঝেসাঝেই করোনা আর ডেঙ্গুর মাঝে গুলিয়ে ফেলছি, তখন বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো নতুন এই টমেটো ফ্লু পরিস্থিতি জটিল বৈ সহজ করবে না। আর তারচেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, করোনা নিয়ে চলতে গিয়ে আমরা খুব ভালো মতো জেনে গেছি ভাইরাসের কোনো ধর্ম নেই।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে করণীয় কী? 

যেকোনো সময় চোখ উল্টাতে পারে যেকোনো ভাইরাস। মিউটেশন হয়ে আবির্ভাব হতে পারে নতুন-নতুন আর আগ্রাসী যত ভ্যারিয়েন্ট।

২০২১ সালে বছর যেমন ডেল্টার অবয়বে আমরা দেখেছিলাম করোনার সংহারী রূপ। কাজেই আপাতত যে টমেটো ফ্লু তেমন বড় কোনো ঝামেলা করছে না, সেই টমেটো ফ্লুই যে সামনে কোনো খারাপ ভ্যারিয়েন্টের জন্ম দেবে না, তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। কাজেই আমাদের টমেটো ফ্লু সম্পর্কে জানতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে।

(লেখাটি লিখতে সহযোগিতা করেছেন ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, রিসার্চার, এহিমি ইউনিভার্সিটি, জাপান)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) ।। ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়