শেখ রেহানা : নির্মোহ জীবন যার
মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলো যেখানে পড়ে ঠিক তার পাশেই অন্ধকার। সেই অন্ধকারেও এমন কেউ কেউ থাকেন, যাদের আলোয় মঞ্চ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সাদা চোখে সেই আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। তেমনই একজন মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা।
রাজনীতিতে শেখ রেহানা নিজেকে সক্রিয় দেখতে চান না, কিন্তু রাজনীতি যে তার রক্তের সাথে মিশে আছে। তার সেই রাজনীতি হচ্ছে দেশপ্রেমের, মানবকল্যাণ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার। এই কারণেই তিনি বোন ও সন্তানদের নেপথ্যে থেকে সবাইকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এখানেই শেখ রেহানা নিজেকে একজন ব্যতিক্রমী মানুষের স্থান তৈরি করছেন।
বিজ্ঞাপন
শেখ রেহানা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৫৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তার জন্ম।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যার সময় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ওই হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে জার্মানিতে বেড়াতে যান দুই বোন।
আরও পড়ুন : শেখ রেহানা : আড়ালের দৃপ্ত মানুষ
বড় বোন শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল ছিল জার্মানি। হত্যাকাণ্ডের রাতে দুই বোন ছিলেন বেলজিয়ামে। নৃশংস সেই হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি বদলে যায় দ্রুত। সেখান থেকে জার্মানি হয়ে ভারতে আসেন তারা। পরে লন্ডনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন শেখ রেহানা।
সরাসরি রাজনীতিতে দেখা যায়নি শেখ রেহানাকে। তবে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কাছে ‘ছোট আপা’ হিসেবে পরিচিত তিনি। শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বড় ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক আওয়ামী লীগের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি। বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের লেবার পার্টি থেকে পরপর দুই বারের নির্বাচিত পার্লামেন্ট মেম্বার। আর ছোট মেয়ে আজমিরা সিদ্দিক রূপন্তী লন্ডনে গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইজার হিসেবে কাজ করছেন।
১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছিলেন, অসীম সাহস এবং সক্ষমতার পরিচয় দেখিয়ে তিনি অনেক জায়গায়ই সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি জাতির দুর্যোগ এবং ক্লান্তিলগ্নে সবসময় আশা জাগানিয়া পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অভিভাবক হিসেবেও তিনি অনন্য।
১/১১ এর সময় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর গভীর সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের রাজনীতি। আওয়ামী লীগকে ভাঙার চেষ্টা হয়, শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র হয়। তখন পর্দার আড়ালে থেকে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে সেই সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধারে বড় ভূমিকা রাখেন শেখ রেহানা। সরাসরি রাজনীতি না করলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রশ্নে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রশ্নে তিনি অবিচল।
যারা ‘হাসিনা : অ্যা ডটার’স টেল’ দেখেছেন, তারা জানেন, তিনি কেমন আবেগী। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিশোধে বেদনার উপশম হয় না। বড় বোন শেখ হাসিনা তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, আগলে রেখেছেন। কতদিন এক বোন আরেক বোনকে জড়িয়ে ধরে ভেসে গেছেন কান্নার সাগরে।
আরও পড়ুন : শেখ রেহানা : এক দুঃখিনী রাজকন্যার গল্প
শেখ হাসিনা ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের হাল ধরে আছেন, এক যুগ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। কিন্তু শেখ রেহানা কিছুতেই নেই; না সংগঠনে, না ক্ষমতায়। অদ্ভুত এক নির্মোহ জীবন তার। বড় বোনকে আগলে রাখা ছাড়া তার আর কিছুই চাওয়ার নেই। এই বোনই তার মা, এই বোনই তার বাবা, এই বোনই তার অভিভাবক। শেখ হাসিনা এখনো যেভাবে আদরে-মমতায় জড়িয়ে রাখেন শেখ রেহানাকে; মনে হয় তার বয়স এখনো সেই ২০ বছর।
শেখ রেহানা এক স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় দেখতাম, আব্বা প্রায়ই থাকতেন জেলখানায়। আমাদের কাছে ঈদ ছিল তখন, যখন আব্বা জেলখানার বাইরে থাকতেন, মুক্ত থাকতেন। আব্বাও জেলের বাইরে, ঈদ এলে এমন হলে তো কথাই নেই। আমাদের হতো ডাবল ঈদ।’
নিরহংকারের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ শেখ রেহানা। বোন চারবারের প্রধানমন্ত্রী অথচ চরিত্রে তার কোনো চিহ্ন নেই। রোহিঙ্গাদের নির্মম নির্যাতনের চিত্র সচক্ষে দেখতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কক্সবাজারের উখিয়ায় গিয়েছেন এবং রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বোন শেখ হাসিনাকে সাহায্য করেছেন।
অভিভাবক হিসেবে তিনি অনন্য। শুধু কি তাই, প্রধানমন্ত্রীর ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ব্যাপারেও তিনি জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি শেখ হাসিনাকে বলতেন, আপা তুমি বড়, তাই তুমি রাজনীতিটা কর আর আমি তোমার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করি।
আজকে শেখ হাসিনার ছেলেমেয়েরা বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন এবং তার ফলাফল আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ। আর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ অটিজম ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। এসব কৃতিত্বের ভাগীদার শেখ রেহানাও। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সংগ্রাম করে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়। রিফিউজি হিসেবে ছিলেন তিনি, তারপরেও টিকে ছিলেন জীবন সংগ্রামে।
শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও সক্রিয় রাজনীতির সামনের সারিতে আসেননি শেখ রেহানা। তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থেকে সহযোগিতা করে গেছেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে অনেকটা নেপথ্যে থেকেই ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর এই কনিষ্ঠ কন্যা।
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি স্মৃতি জাদুঘর করে দেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন শেখ রেহানা। একইভাবে ধানমন্ডিতে তার নামে বরাদ্দ বাড়িটিও দান করে দিয়েছেন দেশের কাজে। বড় বোন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কাছে যিনি শুধুই আদরের রেহানা।
২০২২ সালের ১৭ মার্চ বাবার জন্মদিনে শেখ রেহানা শিশুদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার বোন শেখ হাসিনা প্রবাস থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন দেশে ফিরবেন সিংহের মতো। ঘাতকদের ভয় করলে চলবে না। তাই আমি তাকে সিংহ বলেই ডাকি।’
দেশে ফিরে আব্বার অনেক স্বপ্ন বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ে তুলবেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন-ঠিক মুজিবের মতো করেই মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করলেন। এখনো কাজ করে যাচ্ছেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এইভাবে স্মৃতিচারণ করেন, শেখ হাসিনার মুক্তি দাবিতে লন্ডনে যে আন্দোলন হয় তার নেপথ্যে নায়ক ছিলেন শেখ রেহানা। তার নির্দেশে যুবলীগের নেতাকর্মী এবং আওয়ামী লীগেরও কিছু নেতাকর্মী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শেখ হাসিনার পর আওয়ামী লীগের ঐক্য ও সাংগঠনিক শক্তি ধরে রাখার জন্য রেহানাই উপযুক্ত নেত্রী বলে বিবেচিত হবেন।
এজন্যই শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমনে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলাম—হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি; দুটো পদের দায়িত্বভার বহন করা তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তুমি শেখ রেহানাকে দলের নির্বাহী সভানেত্রী করে নাও। শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমি রাজি। আপনি রেহানাকে রাজি করান। আমি এই মুহূর্তে দলের নির্বাহী সভাপতির পদে তাকে বসাতে তৈরি আছি। আমি তাকে বলেছিলাম। সে বলে, আমি তাহলে এই মুহূর্তে লন্ডনে ফিরে যাব।’
আমিও একবার রেহানাকে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। রেহানা হেসে বলেছেন, ‘আমি তো আপনাকে সব সাহায্য দিচ্ছি। তাহলে সামনে গিয়ে মুখ দেখাতে হবে কেন? রেহানার কথা সত্য। তিনি যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ইত্যাদি সব সংগঠনের উপদেষ্টা ও অভিভাবক। কিন্তু কোনো পদ গ্রহণে একেবারেই অনাগ্রহী।
আরও পড়ুন : আমি তোমাদেরই লোক
শেখ রেহানা একজন সাধারণের মতোই জীবনযাপন করেন। কখনো তিনি অহংকারী মনোবৃত্তি পোষণ করেননি। তিনি মানুষকে প্রগাঢ়ভাবে আদর, মমতা ও ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখতে পারেন। দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে-নিভৃতে। সংগ্রাম করে যাচ্ছেন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, সুযোগ্য মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি তিনি।
মা ফজিলাতুননেছা মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। যার অনুপ্রেরণায় শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছিলেন। আর এখন পর্দার অন্তরালে বড় বোন শেখ হাসিনাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শেখ রেহানার ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই শান্তির আলোকবর্তিকা হাতে বিশ্বময় খ্যাতি অর্জন করেছেন শেখ হাসিনা।
শেখ রেহানা বেগম মুজিবের পরিপূরক হয়ে উঠেছেন তার কর্মে এবং যোগ্যতার মাপকাঠিতে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বিপৎসংকুল পর্যায়গুলোয় আগলে রাখেন ও সঠিক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।
শেখ হাসিনা ছোট বোনের মধ্যে বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিবের ছায়া দেখতে পান। শেখ রেহানা ছাড়া শেখ হাসিনা পরিপূর্ণ নন। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হয়েও সবসময় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও তাকে রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন কিংবা রাজনীতি-বিমুখ ভাবার কোনো কারণ নেই।
যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন শেখ রেহানা আড়াল থেকেই তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি দেশ জাতি এবং গণতন্ত্রের জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার ত্যাগ, প্রেরণা এবং অন্তহীন সাপোর্টে দেশরত্ন শেখ হাসিনা আজ সফল রাষ্ট্রনায়ক। আজ জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে অনেক জানাই শুভেচ্ছা।
এন আই আহমেদ সৈকত ।। উপ-তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ