সড়ক দুর্ঘটনা : জ্যামিতিক হারে বাড়ছে কেন?
ঘুম থেকে উঠেই হৃদয় অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফতাব হোসাইন (৪৫) সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন।
২ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার দিবাগত রাত ১২.৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেট এলাকায় বেপরোয়া একটি প্রাইভেটকার আফতাব হোসাইনের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দুর্ঘটনার পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিজ্ঞাপন
চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাদেকুল ইসলাম দুর্ঘটনায় ড. আফতাব হোসাইনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাস চালক মাসুদ পারভেজকে আটকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে স্থানীয় জনগণ।
আরও পড়ুন : মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার। হাটহাজারীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ। হাটহাজারীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে পবর্তীতে তাকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ক্যাম্পাস সংলগ্ন হাটহাজারীর প্রধান সড়কে সিএনজি ও বাসের বিপরীতমুখী সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন তিনি। একই দুর্ঘটনায় সিএনজি ড্রাইভারসহ তিনজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সড়ক দুর্ঘটনার তালিকা কিন্তু ছোট নয়, বরং দীর্ঘ। এর সাথে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সড়ক দুর্ঘটনা আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের ঘটনাগুলো যুক্ত করলে তালিকা আরও দীর্ঘ হবে।
পরবর্তীতে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহকে গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় সংলগ্ন মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার শারীরিক অবস্থায় ক্রমাবনতি দেখে গুরুতর আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দিন রাত ১০টায় তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
২৭ জানুয়ারি ২০২১। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামরুল হুদা। সিআরবিতে চলন্ত রিকশা উল্টে গেলে বাম পায়ে ও মাথার বাম পাশে আঘাত পান তিনি। পরবর্তীতে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) নেওয়া হলে বাম পায়ের উরুসন্ধিতে ভাঙন দেখা যায়।
অবস্থার ক্রমাবনতি হলে তাকে ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার কল্যাণপুরে বাংলাদেশ স্পাইন অ্যান্ড অর্থোপেডিক হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
আরও পড়ুন : এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!
অধ্যাপক ড. কামরুল হুদা ২০১৫ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেন। প্রায় ২ বছর ৯ মাস দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৮ সালের ২২ মার্চ তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। ১ এপ্রিল তার পদত্যাগ পত্র গৃহীত হয়। এরপর থেকে তিনি উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করছিলেন।
২০১৩ সালেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এগারো মেইল নামক এলাকায় সিএনজি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ডান পা চিরতরে হারান বাংলা বিভাগের প্রতিভাবান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক। অন্য একটি সিএনজি উল্টো দিক থেকে প্রচণ্ড গতিতে এসে আঘাত করে আবু বকর সিদ্দিক ভাইয়ের সিএনজিকে।
যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দিনে দিনে জ্যামিতিক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য সড়ক দুর্ঘটনার উপরে শতভাগ কারও হাত থাকে না...
উল্টো দিকের সিএনজি চালকের ভয়াবহ অদক্ষতায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এতে একজন শিক্ষক চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। আবার দুর্ঘটনা পরবর্তীতে চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় তার যে চিকিৎসা হয়েছে, তা প্রায় ভুল চিকিৎসা হয়েছে।
২০১৯ সালে একজন শিক্ষক চট্টগ্রাম শহরমুখী একটি বাস দুর্ঘটনার শিকার হন। এতে অনেক শিক্ষকেরাই আহত হন। এর মধ্যে কেউ কেউ গুরুতর আহতও হন। ২২ আগস্ট ২০১৯। বেলা ১.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শিক্ষক বাস বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে চট্টগ্রাম শহরে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের বড়দিঘীর পাড় এলাকায় দুর্ঘটনা কবলিত হয়।
দুর্ঘটনায় শিক্ষকদের সাথে বাসের চালক ও হেলপারও আহত হন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সহযোগিতায় আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
আরও পড়ুন : দুর্ঘটনা নাকি খুন?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সড়ক দুর্ঘটনার তালিকা কিন্তু ছোট নয়, বরং দীর্ঘ। এর সাথে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সড়ক দুর্ঘটনা আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের ঘটনাগুলো যুক্ত করলে তালিকা আরও দীর্ঘ হবে। অগণিতও বললেও ভুল বলা হয় না।
প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ মারা যান। এত মৃত্যুর পরও এই খাতে আমাদের উদাসীনতা কমেনি। কেন বারবার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে? এর কী কোনো পরিসমাপ্তি নেই? অবশ্যই আছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ।
যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দিনে দিনে জ্যামিতিক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য সড়ক দুর্ঘটনার উপরে শতভাগ কারও হাত থাকে না একথা যেমন সত্য, তেমনি যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে সড়কে অটোরিক্সা, সিএনজি, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, বাস, মিনিবাস, ট্রাক প্রভৃতি যানবাহনের দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসাও সম্ভব। সেই সদিচ্ছা কি আমাদের আছে?
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়