ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ববাজারের চলমান অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে জ্বালানি খাত। ভারসাম্য করে চললেও পৃথিবীর সব দেশেই জ্বালানি সংকট বিদ্যমান। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই পালে আরও হাওয়া তুলেছে।

অর্থনৈতিক মন্দা এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি জ্বালানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছে, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। চাহিদা পূরণের জন্য সব দেশের সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করেছে।

বাংলাদেশ সরকারও আগস্ট মাসের শুরুতে ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন ও অকটেনের মূল্য ৪২ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করেছিল। তবে দাম বাড়ানোর ২৩ দিনের মাথায় আবারও মূল্য সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম কমালো সরকার। এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন বারবার জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করছে সরকার?  

আরও পড়ুন : মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত : সবার জীবন যায় যায় 

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। কিন্তু আমাদের প্রায় নব্বই শতাংশ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের পরিবহণ খাতের প্রায় শতভাগ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ এই জ্বালানি তেল নির্ভর।

জ্বালানি তেল আমদানি কমাতে বন্ধ করা হয় ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়ে যায় সারাদেশে। তাছাড়া বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে তেল কিনতে হয়েছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ছিল ৮৩ দশমিক ৩৫ মার্কিন ডলার, যা গত জুলাই মাসে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৩৯ দশমিক ৪৩ মার্কিন ডলার। তাই তাৎক্ষণিক মূল্য সমন্বয় করার প্রয়োজন পড়ে সরকারের, এক লাফে ৩২ থেকে ৪৬ টাকা বৃদ্ধি পায় ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন ও অকটেনের দাম। বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কারণে জ্বালানি তেলের এই মূল্য বৃদ্ধি অনিবার্য ছিল বলে দাবি সরকারের।

আরও পড়ুন : প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার দায় 

আমদানি ব্যয় সংকোচন, রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা এবং বিপিসিকে লোকসান থেকে রক্ষায় জন্য সরকার মূল্য সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তবে সবক্ষেত্রেই দাম বাড়ে না, জনগণের স্বার্থে কমেও। সেই লক্ষ্যেই শুল্কহার কমিয়ে ২৯ আগস্ট ২০২২, রাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এবং তাৎক্ষণিকভাবেই নতুন শুল্কহার কার্যকর হয়ে গেছে।

এতে ডিজেলে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে এবং ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। শুল্ক-কর কমানোয় ডিজেলের আমদানি ব্যয় কমবে। এর ফলে লিটার প্রতি ৫ টাকা কমানো হয়েছে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের দাম।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তির দিকে। তবু শুল্ক কমিয়ে বিপিসিকে ভর্তুকি দিয়ে দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।’

আরও পড়ুন : জ্বলছে জ্বালানি তেল 

বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার পেছনে বেশকিছু যুক্তি আছে সরকারের। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের কাছে দুটো উপায় ছিল—হয় তেল আমদানি কমিয়ে দেওয়া বা দাম সমন্বয় করা। সব দেশের মতো আমরাও সেভাবে দাম সমন্বয় করেছি।’

২৯ আগস্ট ২০২২। মূল্য সমন্বয়ে ডিজেলের মূল্য ১০৯ টাকা করা হলেও বর্তমান হিসাবে প্রতি লিটারে খরচ পড়বে ১৩১ টাকা, অর্থাৎ প্রতি লিটারে এখনো ২২ টাকা লোকসান বিপিসিকে বহন করতে হবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসিকে ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রিতে প্রায় ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে।

আরও পড়ুন : আইএমএফের ঋণ : জ্বলছে কি জ্বালানি বাজার? 

বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর বাজেটে জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় রাখতে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দেয়, চলতি অর্থবছরের বাজেটেও ভর্তুকিতে ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি প্রদান কোনো দেশের অর্থনীতির জন্য সুবিধাজনক নয়।

সন্দেহ নেই যে, বৈশ্বিক ডলার সংকট এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। তবে অনেকেই মনে করছেন, একবারে ৪২ থেকে ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি।

এটা না করে ধীরে ধীরে বাড়ালে তা সহনীয় হতো। কিন্তু প্রতি মাসে জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি বা সমন্বয় করতে থাকলে অন্যান্য ভোগ্যপণ্য ও পরিবহন সেক্টরে যথেচ্ছ মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়ে যায়। তেল-জলের ধর্ম বিপরীতমুখী হলেও তেলের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের বন্ধুত্ব ঈর্ষণীয়।

সরকার তাই অপেক্ষা করেছে বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য। তবে যে পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল তা আরও পরিষ্কার করা দরকার ছিল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুল্ক কমিয়ে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি উঠতে থাকে। এখন সেই পথেই হাঁটছে সরকার।

আরও পড়ুন : তেলের গায়ে আগুন 

মুনাফা লাভ বা আইএমএফের ঋণ গ্রহণের খাতিরে নয়, দেশীয় অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ কমানোর জন্যই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে সরকারের তরফ থেকে।

সরকারি হিসেবেই দেশের অর্থনীতিতে আগামী ছয় মাসের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জ্বালানি সংকট। আগামী দিনে বিশ্ববাজার স্থিতিশীল হলে আবারও দাম কমিয়ে সমন্বয় করার সুযোগ রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে দৈত্যাকার বৈশ্বিক সংকটের মুখে দেশ নিরুপায়।

সংকট মোকাবিলার দায়িত্ব সরকার ও জনগণ উভয়কেই নিতে হবে। মূল্যবৃদ্ধির অতিরিক্ত চাপ প্রশমন করার জন্য বৈশ্বিক সংকটের এই মূহুর্তে ভোক্তাপর্যায়ে মিতব্যয়িতা এবং জ্বালানি তেলের ব্যবহারে সচেতন হওয়া জরুরি।

তন্ময় চৌধুরী ।। গবেষক
ctonmoy555@gmail.com