সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার : বন্ধ করায় কি সমাধান?
আমাদের দেশে ‘হুজুগে মেতে ওঠা’ বলে একটা কথা আছে। এই হুজুগে মেতে ওঠার চিত্র খুব চমৎকার করে বর্ণনা করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান তার ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায়। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক যুগের বহু আগে লেখা ওই কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।’
কানের সন্ধানে সারাদিন ছোটার পর গ্রামের ছোট্ট একটা ছেলে শেষে বলে দিল ওই কান তো যেখানে ছিল সেখানেই আছে। তারপর সবাই কানে হাত দিয়ে দেখল, এই কথাই ঠিক। তখন তারা বলল, ‘ঠিক বলেছে, চিল তবে নয়কো কানের যম, বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হলো শ্রম।’
বিজ্ঞাপন
এই অবস্থা আমাদের এখনো যায়নি। আমরা এখনো হুট করেই হুজুগে মেতে উঠি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চর্চা নিয়ে সেই হুজুগে মেতে ওঠার অভ্যাস খুব ভালো করেই দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে হুজুগে মেতে ওঠার বিষয় খুব লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুন : সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কীভাবে ছড়ায়?
কেউ কারও কাছে কিছু একটা শুনল, একটা পোস্ট দিয়ে দিল। তারপর সেই পোস্ট দেখে আরেক দল হুজুগে মেতে উঠল। তারপর হামলা-মামলা অনেক কিছু শেষে দেখা গেল, আসলে ঘটনা কিছুই ছিল না। অনেক সময় এমনও হয়েছে, পোস্ট দেওয়া হয়েছে একটা, আর তার নামে গুজব ছড়িয়েছে আরেকটা।
যারা পোস্টের কথা শুনেই শরীরে একশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় উত্তেজনা অনুভব করেছেন, তারা আসলে পোস্ট পড়েও দেখেননি, অনেকে পোস্ট কাকে বলে তাও জানেন না! একদল সুযোগ সন্ধানী মানুষ আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের হুজুগে মেতে ওঠার সুযোগ নিচ্ছে নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটা প্ল্যাটফর্ম। আগে মাইকে ঘোষণা দিয়ে গুজব ছড়ানো হতো, এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আগে গুজব ছড়ানোর জন্য যেমন আমরা মাইকের ব্যবহার বন্ধ করতে পারিনি, এখনো তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয়।
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীদের যেমন সচেতন হওয়া জরুরি, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যারা ব্যবহার করছেন তাদেরও দায়বদ্ধ থাকা উচিত। কিন্তু যদি দায়িত্বশীলরাও হুজুগে মেতে উঠে আজ এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, কাল ওই মাধ্যম বন্ধ করার সুপারিশ করেতে থাকেন, তাহলে সেটাও হবে অবিবেচনা প্রসূত কিংবা আত্মঘাতী।
আরও পড়ুন : সাইবার বুলিংয়ের শিকার শিশু থেকে তারকা : সমাধান কোথায়?
একটা অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, আমাদের দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অনেকেই আবেগী কণ্ঠে হুজুগে বক্তৃতা দিতে পছন্দ করেন, কিন্তু গবেষণা করতে কিংবা বিষয়ের গভীরে খতিয়ে দেখতে চান না। এমনকি অনেক সরকারি সিদ্ধান্তের আগেও যথেষ্ট গবেষণা, অনুসন্ধান হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই হুজুগে সিদ্ধান্ত চলে আসে, আবার কিছুদিন পরই সেই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করতে হয়।
মানুষের মধ্যে আরও বেশি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়। যারা সুপারিশ দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি কখনো গবেষণা করে, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতটা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক, কতটা ক্ষতিকর?
বিশ্বের কোন দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরে যা কিছু নেতিবাচক তার জন্য কতটা মাধ্যম দায়ী, আর কতটা আমাদের নিজেদের ব্যবস্থাপনা দায়ী? একটা প্ল্যাটফর্ম কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য আমরা দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে কতটা দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছি?
যখন ফেসবুক আসলো, তখন কথায় কথায় ফেসবুককে গালি দেওয়া হত। ফেসবুক সবকিছু শেষ করে দিচ্ছে, ফেসবুক ঘিরে প্রতারণা হচ্ছে। ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না! কত রকম গালি যে ফেসবুককে দেওয়া হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। ফেসবুকের পরে গালি শুরু হলো ইউটিউব ঘিরে। এমনকি বড় বড় দায়িত্বশীল মানুষ বলতে লাগলেন ইউটিউবাররা খারাপ! হাল আমলে গালি দেওয়া শুরু হয়েছে ‘টিকটক’কে।
আরও পড়ুন : মুঠোফোনে আসক্তি বাড়ার কারণ কী?
ট্রেনের ছাদে উঠে ভিডিও করতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে কেউ মরলে বলা হচ্ছে টিকটকের জন্য ভিডিও করছিল, অতএব টিকটকই দায়ী? কেউ প্রশ্ন তুলছেন না, চলন্ত ট্রেনের ছাদে একজন মানুষ উঠে ভ্রমণের সুযোগ পায় কীভাবে? ভিডিও তো পরের কথা।
বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে মানুষ ট্রেনের ছাদে উঠছে এবং ছাদ থেকে পড়ে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এখন রেল কর্তৃপক্ষ ছাদে অবৈধভাবে ভ্রমণ করার সুযোগ দেওয়ায় নিজেদের অপকর্মের দায় টিকটকের উপর চাপানোর একটা ভালো অজুহাত পেয়েছেন!
পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং মারামারি করছে কুড়াল, চাপাতি নিয়ে। ব্যস, বলে দেওয়া হচ্ছে টিকটক ভিডিও করতে এসে মারামারি হয়েছে! খতিয়ে দেখা হচ্ছে না যুগ যুগ ধরে পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং তৈরি করছে কারা? কিশোর গ্যাং তৈরি করে পাড়ার রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা।
চুল পাকা বাপ-দাদার বয়সী মানুষেরাই নিজেদের অনৈতিক কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কিশোর গ্যাং-এর জন্ম দেন। কিশোর গ্যাং এর বড়ভাই, গডফাদারেরা এখন নিজেদের আড়ালে রাখার জন্য টিকটকের মতো মোক্ষম কিছু পেয়েছেন!
বাংলাদেশ থেকে নানা প্রলোভনে মানব পাচার বহুদিন থেকেই ঘটছে। পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। সভ্য দুনিয়ায় বিশ্ব রাজনৈতিক কর্তৃত্বের চরম ব্যর্থতার একটি নজির মানব পাচার। বাংলাদেশে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে মানব পাচার বন্ধের জন্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বারবারই কৌশল পরিবর্তন করেছে মানব পাচারের জন্য। কিন্তু মানব পাচারকারীদের নতুন কৌশল মোকাবিলার ব্যর্থতাও আড়াল করা হচ্ছে ফেসবুক, টিকটকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে।
আরও পড়ুন : পাবজি : অনলাইন গেইমের রীতিনীতি ও অর্থনীতি
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কি কোনো দায় নেই? অবশ্যই দায় আছে। যে মাধ্যমে একটা বক্তব্য, একটা ছবি, একটা ভিডিও মুহূর্তেই বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার দায় অবশ্যই সেই মাধ্যমের আছে। একই সঙ্গে তাদের দায়বদ্ধ করারও বিষয় আছে। এজন্য আমাদের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বুঝতে হবে।
ফেসবুক এক ধরনের মাধ্যম, ইউটিউব এক ধরনের মাধ্যম, টিকটক এক ধরনের মাধ্যম, টুইটার এক ধরনের মাধ্যম। প্রত্যেক সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম তাদের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি, নীতি এবং বাণিজ্যিক কৌশলে পরিচালিত হয়। আমরা যদি আমাদের দেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে এখানে এখন পর্যন্ত সরকার বিরোধী অপপ্রচার, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চরিত্র হননের ঘটনা ঘটেছে ফেসবুক এবং ইউটিউব ভিডিও’র মাধ্যমে। গুজব ছড়ানো এবং তার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মতো যত ঘটনা আছে তার সবই ঘটেছে ফেসবুক পোস্ট এবং লাইভ সম্প্রচারকে কেন্দ্র করে।
প্রথম দিকে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও ফেসবুক, ইউটিউব থেকে অপপ্রচারমূলক পোস্ট, ভিডিও খুবই সরানো গেছে। তবে ফেসবুক এখন আগের চেয়ে বেশি দায়বদ্ধ আচরণ করছে। আপত্তিকর কিংবা অপপ্রচারের পোষ্টগুলো আগের চেয়ে বেশি সরাচ্ছে। কারণ ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আগে বাংলাদেশের বাজারকে গুরুত্ব দেয়নি, এখন দিচ্ছে। কিন্তু ইউটিউব এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে পাত্তাই দেয় না। বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের কোনো ‘রিপোর্ট’ আমলেই নেয় না। কারণ ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশের বাজারের এখন পর্যন্ত কোনো গুরুত্বই নেই, এই কারণে কোনো দায়ও অনুভব করে না।
আরও পড়ুন : টিকটক, লাইকি, পাবজিরই কি সব দোষ?
তবে ইউটিউব যে দেশের কোম্পানি, ফেসবুকও সেই একই দেশের কোম্পানি। সেই দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কও আছে। যদি ওই দেশের সঙ্গে খুবই কার্যকর ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিটেন্স ট্রিটি (এমলাট)’ থাকত তাহলে কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমেই ইউটিউবকে অনেক বেশি দায়বদ্ধ করা যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের কেস টু কেস কিছু এমলাট হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পর্কিত এমলাট নেই বলেও জানা যায়। ফলে শুধুমাত্র কিছু সরকারি কর্তৃপক্ষের আন্তরিক যোগাযোগ দিয়ে ফেসবুক, ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে কতটা দায়বদ্ধ করা সম্ভব?
টিকটক হচ্ছে বিনোদন ও শিক্ষামূলক ‘সংক্ষিপ্ত ভিডিও’ প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মে অপপ্রচারেরও তেমন সুযোগ নেই। বরং আমার মনে হয় আমাদের তরুণদের সামনে নির্মল বিনোদনের একটা প্ল্যাটফর্ম টিকটক। যেখানে তারা নিজেরা গান করেন, নাচেন, মজা করেন। অসংখ্য শিক্ষামূলক ভিডিও ব্যবহারকারীরা দিচ্ছেন।
তরুণদের সামনে নির্মল বিনোদেনের সুযোগ কমে আসছে। আগে তো গ্রামের স্কুলেও একটা লাইব্রেরি থাকত, খেলার মাঠ থাকত। এখন তো শুধু খবর আসে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের হাত থেকে খেলার মাঠ রক্ষার জন্য আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা মানববন্ধন করছে।
সন্তানের খেলার মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে দুই বছরের দুগ্ধ পোষ্য শিশুর মাও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাচ্ছেন! স্কুলের লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দ কক্ষ ভাড়া দেওয়া হচ্ছে বিশেষ কোচিং এবং বাণিজ্যিক ক্লাসরুম হিসেবে। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় কনসার্ট হয় না, গানের আসর হয় না, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয় না।
আরও পড়ুন : সাইবার অপরাধ : নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ও আইন
কয়েকটি বিনোদন পার্ক আছে সেখানে ঢুকতে যে প্রবেশমূল্য তাও দেওয়ার সামর্থ্য খুব কম বাবামায়েরই আছে। তাহলে এই কিশোর-তরুণদের সামনে পাড়ার বড়ভাইদের প্ররোচনায় সর্বনাশা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হওয়া ছাড়া আর কী করার আছে?
টিকটক বরং তাদের কিছুটা সময় বিনোদন, শিক্ষায়, নিজের জন্য কিছুটা সময় ব্যয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। তাহলে এই প্ল্যাটফর্ম বন্ধের সুপারিশ যারা দিচ্ছেন, তারা কি যৌক্তিক চিন্তা থেকে এটা করছেন? বরং যতটা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এখনো পর্যন্ত আপত্তিকর ভিডিও সরিয়ে নিতে বাংলাদেশকে সবগুলো প্ল্যাটফর্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দিচ্ছে টিকটক কর্তৃপক্ষই।
আসলে কোনো প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়। আমরা বরং আমাদের সন্তানদের বলতে পারি, শেখাতে পারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কীভাবে, কতটা সুন্দরভাবে নিজেকে, নিজের সৃষ্টিকে তুলে ধরা যায়, কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখতে হয়।
রাশেদ মেহেদী ।। সভাপতি, টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ