বিদ্রোহী রণক্লান্ত
বাংলা কাব্যে কানন বিহারি অগ্নিবীণা বাদক রণতূর্যক চির দ্রোহ ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনাদর্শ এক হাতে প্রশান্তির বাঁকা বাঁশের বাঁশরী ও অন্যহাতে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের খড়গ কৃপাণ।
জাতীয় কবির জীবনাদর্শ বিশ্লেষণ করলে আমরা আবহমান বাংলার মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি খুব সহজেই প্রত্যক্ষ করতে পারি। কবির জন্ম ও মৃত্যুর সময়কাল বাঙালি ও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সময়ের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবির জন্ম হয় এক সাম্রাজ্যে। কবির যৌবনকাল আসে আরেক সাম্রাজ্যে ও মৃত্যু ঘটে আরেক জায়গায়।
বিজ্ঞাপন
১৮৯৯ থেকে ১৯৭৬ কালপর্বে আমরা ভারত উপমহাদেশের অনেক কিছু ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটেছে। কবির জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে একজন ব্যক্তি নজরুলের জীবনালেখ্যর চেয়ে একজন বাঙালি ও বাংলাদেশি নজরুলের প্রভাব অনেক বেশি বলে মনে করা হয়।
গল্প, কবিতা, অভিনয়, উপন্যাস কিংবা সংগীত-সাহিত্য ও শিল্পের সব শাখায় তার আগমন ছিল ধূমকেতুর মতো। আপন সৃষ্টির আলোয় নতুন দিনের আগমনী বার্তা দিয়ে এঁকে দিয়েছিলেন নবদিগন্তের উজ্জ্বল রেখা। শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় আজও তিনি ‘উন্নত মম শির’।
আরও পড়ুন : নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য
নিপীড়িতের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি কিংবা প্রেম ও মানবতার বাণীতে আজও তিনি সমুজ্জ্বল। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে নজরুলের সৃষ্টিকর্মেও রয়েছে বেশ প্রাসঙ্গিকতা। নজরুল কালোত্তীর্ণ এক কবি যার প্রাসঙ্গিকতা কোনো সময়ের আবর্তে কিংবা ভূগোলের বিভাজনে বিভক্ত নয়।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন নিপীড়িত মানবতার কবি। সারা জীবন তিনি সমাজের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কলম ধরেছেন। তিনি নির্ভীক চিত্তে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তার ক্ষুরধার রচনা অব্যাহত রেখেছেন। থেকেছেন আপসহীন লোভ–খ্যাতির মোহের কাছে মাথা নত করেননি। কারা নির্যাতনেও বিচ্যুত হননি লালিত আদর্শ থেকে। অন্যদিকে তিনি মানুষের হৃদয়ের কোমল অনুভূতির প্রতিও সমান আবেগে সাড়া দিয়েছেন। অজস্র গানে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলার সংগীত ভুবন। প্রবর্তন করেছিলেন বাংলা গজল।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল ঘটনাবহুল। শৈশব থেকেই লেটো দলের বাদক, রুটির দোকানের শ্রমিক এভাবেই পেরিয়ে গেছে তার শৈশব–কৈশোর। পরে কাজ করেছেন সৈনিক হিসেবে। সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করছেন এইচএমভি ও কলকাতা বেতারে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছেন। পাশাপাশি সাহিত্যসাধনা তো ছিলই। শাসকের কোপানলে পড়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন কিন্তু নত হয়নি নজরুলের উচ্চ শির।
১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে। এই সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন।
একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামি চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।
আরও পড়ুন : অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক?
মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশিদিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন।
এছাড়া ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবি বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন।
নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসংগীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘চাষার সঙ’, ‘শকুনীবধ’, ‘রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ’, ‘দাতা কর্ণ’, ‘আকবর বাদশাহ’, ‘কবি কালিদাস’, ‘বিদ্যাভূতুম’, ‘রাজপুত্রের গান’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং ‘মেঘনাদবধ’।
একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তবজীবন, অন্যদিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল প্রচুর শ্যামাসংগীত রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষণে উল্লেখ্য করেন, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু–মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
আর্থিক সমস্যা তাকে বেশিদিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন।
আরও পড়ুন : পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন
এভাবে কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহর সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন।
১৯১৫ সালে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ সালের শেষ দিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন।
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়।
প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস ‘বাঁধন হারা’ এবং কবিতা ‘বোধন’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘বাদল প্রাতের শরাব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়া-পারের তরণী’, ‘কোরবানি’, ‘মোহরর্ম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্’, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার ‘খেয়া-পারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এরপর দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়।
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে।
আরও পড়ুন : নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পটভূমি
১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘ভাঙার গান’ সংগীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।
বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে ‘কামাল পাশা’—এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কবিতায় পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়া-পারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা ‘খুকী ও কাঠবিড়ালি’, ‘লিচু-চোর’, ‘খাঁদু-দাদু’ ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
আরও পড়ুন : অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের
নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। ১৯৩৮ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন। সেখানে তিনটি অনুষ্ঠান যথাক্রমে 'হারামণি', 'নবরাগমালিকা' ও 'গীতিবিচিত্রা'র জন্য তাকে প্রচুর গান লিখতে হতো। 'হারামণি' অনুষ্ঠানটি কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রতি মাসে একবার করে প্রচারিত হতো যেখানে তিনি অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় রাগরাগিণী নিয়ে গান পরিবেশন করতেন। উল্লেখ্য, এই অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি কোনো একটি লুপ্তপ্রায় রাগের পরিচিতি দিয়ে সেই রাগের সুরে তার নিজের লেখা নতুন গান পরিবেশন করতেন।
এই কাজ করতে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম নবাব আলী চৌধুরীর রচনায় 'ম আরিফুন নাগমাত' ও ফার্সি ভাষায় রচিত আমীর খসরুর বিভিন্ন বই পড়তেন এবং সেগুলোর সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের রাগ আয়ত্ত করতেন। এসব হারানো রাগের ওপর তিনি চল্লিশটিরও বেশি গান রচনা করেন।
তবে স্বভাবে অগোছালো হওয়ায় নজরুল টুকরো কাগজে এসব গান লিখলেও সেগুলো মাসিক ভারতবর্ষের সংগীত বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জগৎ ঘটক একটি মোটা বাঁধানো খাতায় স্বরলিপিসহ তুলে রাখতেন। বাংলা গানের দুর্ভাগ্য যে, এই সংকলিত খাতাটি পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যায় যার বিজ্ঞপ্তি তিনি সেই সময় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে দিয়েছিলেন কিন্তু সেটি আর পাওয়া যায়নি।
নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এখানে বসেই বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’।
১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম ‘ব্যথার দান’—এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন : শতাব্দীর পশ্চাতে নজরুল অবলোকন
নজরুল 'ধূপছায়া' নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এটিতে তিনি একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’র ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘গৃহদাহ’ চলচ্চিত্রের সুরকার ছিলেন তিনি। গীতিকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন ১৯৩৩ সালে পাইওনিয়ার ফিল্মস কোম্পানির প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ধ্রুব’ এবং সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন ১৯৩৭ সালের ‘গ্রহের ফের’ চলচ্চিত্রের।
১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ চলচ্চিত্রের ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত ‘গোরা’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। ১৯৩৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাপুড়ে’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার ও সুরকার ছিলেন তিনি।
‘রজত জয়ন্তী’, ‘নন্দিনী’, ‘অভিনয়’, ‘দিকশূল’ চলচ্চিত্রের গীতিকার ছিলেন নজরুল। ‘চৌরঙ্গী’ চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। চৌরঙ্গী হিন্দিতে নির্মিত হলেও তার জন্য ৭টি হিন্দি গান লেখেন তিনি।
১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে প্রণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভাগ্নি নার্গিস আসার খানমের সাথে।
আরও পড়ুন : রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য
বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরে কাবিনে নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাঁধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হওয়ার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়েও চার সন্তানের নাম বাংলা এবং আরবি/ফারসি উভয় ভাষাতেই নামকরণ করেন। যেমন, কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই অর্থাৎ ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুস্পষ্টরূপে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে স্বাধীন বাংলাদেশে আনার পর ঢাকায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই ভর্তি করান। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) ৭৭ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত নজরুল এই ১১৭ নম্বর কক্ষেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরবর্তীতে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে ছিল এক অনন্য যুগলবন্দি। দুজনেই বাংলার অপরাজেয় বীর, দুজনেই ট্র্যাজেডির নায়ক। তারা উভয়েই প্রবল জাতীয়তাবাদী। তাঁদের এই জাতীয়তাবাদের শেকড় এক জায়গাতেই প্রোথিত। আর এই জাতীয়তাবাদ মানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তাদের মাঝে ব্যক্তিগত যোগাযোগও ছিল অনেক। বিবিসি'র জরিপে এই দুই বাঙালির একজন দখল করে আছেন সর্বকালের সেরা বাঙালির এক নম্বর স্থানে আর অন্যজন দখল করেছেন তিন নম্বর স্থানে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মে এই দুই বিপ্লবী হয়ে আছেন ইতিহাস।
আরও পড়ুন : নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা
স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে সপরিবারে বিদ্রোহী কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এই সময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে তাকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালে তাকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়।
বঙ্গবন্ধু এবং নজরুল আমাদের জাতীয় জীবনে দুই স্তম্ভ। একজন স্বাধীনতার মহান স্থপতি আর অন্যজন স্বাধীনতার জাগরণী আনা বিপ্লবী। একজন কথায়, কবিতায় ও গানে আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে উসকে দিয়েছেন আর একজন আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করেছেন।
উভয়েই যেমন সাম্যবাদী, তেমনি অসাম্প্রদায়িক এবং তেমনি নিপীড়িত শোষিতের কণ্ঠস্বর। একজন যেমন অগ্নিবীণায় ব্রিটিশকে পর্যুদস্ত করে তুলেছেন তেমনি অন্যজন সাত মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ দিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন বিশ্বকে। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল শাসকের তখ্ত যেমন আঘাত করেছেন তেমনি ছয়দফা'র মোক্ষম হাতিয়ারে বঙ্গবন্ধু কাঁপিয়ে দিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভিত।
আমি মনে করি সংকট মোচনে, অন্যায় ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে চিরকাল প্রেরণা দেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনির হুংকার ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ। বর্তমান সময়েও যেকোনো অশুভ তৎপরতার বিষয়ে আমাদের সতর্ক থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জাতীয় কবির আদর্শকে ধারণ করে কাজ করে যেতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ।। উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়