মামলার সাক্ষী শালিক পাখি
হোসেন সোহেল আমার খুবই পছন্দের মানুষ। একসময় আমরা সহকর্মীও ছিলাম। সোহেল আমাদের মতো সাধারণ নন। কাজের ক্ষেত্রই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। এই পাগলাটে, বাউন্ডুলে মানুষটি কাজ করেন প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে।
শুধু কাজ করেন বললে পুরোটা বলা হয় না। তিনি প্রকৃতি, বন, পাহাড়, প্রাণী ভালোবাসেন অন্তর দিয়ে। সেই ভালোবাসা তিনি তুলে আনেন গণমাধ্যমে। সোহেল একা নন, প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা মানুষের সংখ্যা এখন বাড়ছে।
বিজ্ঞাপন
প্রকৃতি নিয়ে কাজ আগে থেকেই হচ্ছে। তবে বন্য প্রাণী নিয়ে সচেতনতার কাজটা খুব বেশিদিনের নয়। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, মানুষ গুলতি বা এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করছে। শিকার অনেক মানুষের শখ। কিন্তু আপনার যেটা শখ, সেটা তো এই প্রকৃতির অন্য প্রাণীর জন্য মৃত্যু। আর ধরিত্রী শুধু মানুষের নয়। পশু, পাখি, প্রাণী-সবার।
আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?
ছেলেবেলার কথা বলছিলাম। শুধু এয়ারগান নয়, নানান ফাঁদ পেতেও পাখি শিকার করা হতো। গ্রামে পাগলা কুকুর বা হুলো বিড়াল পিটিয়ে মারার দৃশ্যও দেখেছি অনেক। আমরা কথায় কথায় বলি, ‘কুকুরের মতো পেটানো’, এই কথার পেছনের কথা হলো, মানুষকে কুকুরের মতো নির্দয়ভাবে পেটানো যাবে। কিন্তু কুকুরকে পেটালে ক্ষতি নেই। যেন কুকুরের প্রাণ নেই, ব্যথার অনুভূতি নেই।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ প্রয়াত জয়নাল হাজারী একবার বলেছিলেন, যে বাঘ মানুষ মারে, সেই বাঘকে বাঁচিয়ে রাখতে এত কথা কেন? সুন্দরবনের সব বাঘ মেরে ফেললেই তো মানুষ নিরাপদে থাকবে।
‘পরান (২০২২)’ আর ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমা দুটি যেন বাংলাদেশের ঝিমিয়ে পড়া চলচ্চিত্রে নতুন হাওয়া এনেছে। ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমা মুক্তির আগেই ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি মানুষের মুখে মুখে।
জয়নাল হাজারীর মতো এমন ভাবনার মানুষ কিন্তু দেশে কম নেই। তবে আশার কথা হলো হোসেন সোহেলের মতো মানুষও দেশে বাড়ছে। মানতেই হবে অ্যাক্টিভিস্টদের তৎপরতায় বন্য প্রাণী নিয়ে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। এখন আর হুটহাট কোনো প্রাণী পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় না, প্রতিবাদ হয়।
কার্নিশে আটকে পড়া বিড়াল উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের এগিয়ে আসার মতো ঘটনাও এখন বাংলাদেশে ঘটে। লোকালয়ে চলে আসা বন্যপ্রাণীকে না মেরে আটক করে বনে ছেড়ে দেওয়ার উদাহরণও কম নয়।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা
বছর দশেক আগেও ঢাকার রাস্তায় পাখি বিক্রি হতো। এখন এই দৃশ্য দেখা যায় না। কয়েক বছর আগে আমার এক বন্ধু আমাকে হাওরে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। প্রলুব্ধ করার জন্য বলেছিলেন, চলেন আপনাকে শিকার করে পাখির মাংস খাওয়াব। আমি তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করিনি। বরং তাকে অনুরোধ করেছি যেন পাখি শিকার না করে।
হোসেন সোহেল এবং বন্য প্রাণী নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলনের সাথে আমি একমত। তবে ‘হাওয়া (২০২২)’ ইস্যুতে তাদের অবস্থান আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। নাম ‘হাওয়া (২০২২)’ হলেও সিনেমা অঙ্গনে এই সিনেমা রীতিমতো সাইক্লোন তুলে দিয়েছে।
‘পরান (২০২২)’ আর ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমা দুটি যেন বাংলাদেশের ঝিমিয়ে পড়া চলচ্চিত্রে নতুন হাওয়া এনেছে। ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমা মুক্তির আগেই ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি মানুষের মুখে মুখে। ‘হাওয়া (২০২২)’র টিমও দেশের বিভিন্নস্থানে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন।
আরও পড়ুন : এখন তাহলে কোন জীবন থেকে নেবেন?
মুক্তির পর থেকে ‘হাওয়া (২০২২)’র হাওয়া ঝড় থেকে সাইক্লোনে পরিণত হয়েছে। মধ্যবিত্তরা আবার হলে ফিরেছেন। হাওয়া (২০২২)-এর নির্মাণশৈলী, সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনয় নিয়ে আপ্লুত সবাই। গল্প নিয়ে কেউ কেউ ভিন্ন কথা বললেও তাতে দেখার আগ্রহ কিন্তু কমেনি।
কেউ কেউ ‘হাওয়া (২০২২)’ চলচ্চিত্রে অতিরিক্ত গালাগাল নিয়েও কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তবে সেই ‘হাওয়া (২০২২)’ এখন ভিন্ন কারণে বিতর্কের কেন্দ্রে। শুরুটা সম্ভবত করেছিলেন হোসেন সোহেলই।
‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমায় একটি শালিক পাখিকে খাঁচায় পোষার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। সিনেমার এক পর্যায়ে চলচ্চিত্রের চান মাঝি, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, শালিক পাখিকে খেয়ে ফেলতে দেখা গেছে। ‘হাওয়া (২০২২)’ দিয়ে সিনেমা পরিচালনায় আসা মেজবাউর রহমান সুমন দাবি করেছেন চলচ্চিত্রে শালিক পাখি খাওয়ার দৃশ্য থাকলেও সেটি অন্যভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে, পাখি হত্যা করা হয়নি। বরং নির্মাণ শেষে পাখি মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
হোসেন সোহেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শালিক পাখি খাঁচায় বন্দি দেখানো এবং খেয়ে ফেলা দেখানোয় আপত্তি করেছেন। পরে ৩৩টি পরিবেশবাদী সংগঠনও আপত্তি জানিয়েছে এবং সংশ্লিষ্টদের ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে। তবে বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি।
আরও পড়ুন : তারেক মাসুদ : স্বপ্নদ্রষ্টা, আলোকবর্তিকা
বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ‘হাওয়া (২০২২)’র পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনের নামে মামলা করেছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ লঙ্ঘনের অভিযোগে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা করা হয়।
আরেক আইনজীবী ‘হাওয়া (২০২২)’ প্রদর্শন বন্ধ করার জন্য আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। পুরো বিষয়টি আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। কথায় বলে না, সামনে দিয়ে মাছি গেলে আমরা লাফিয়ে পড়ি, পেছন দিয়ে হাতি গেলেও টের পাই না।
সিনেমায় একটি শালিক পাখি খাঁচায় আটকে রাখা এবং খেয়ে ফেলা নিয়ে এত শোরগোল, আর প্রতিদিন দেশে বন উজাড় হচ্ছে। পশু-পাখিদের আবাস ধ্বংস হচ্ছে। শিকার কমলেও পাখি শিকার বন্ধ হয়নি। ২০২১ সালের ৯ এবং ১০ এপ্রিল ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে বাসা ভেঙে ও পুড়িয়ে প্রায় ১৮৩টি বাবুই পাখি হত্যা করা হয়। অনেক সচেতনতার পরও বন্যপ্রাণী মারার ঘটনা এখনো কম নয়।
চলচ্চিত্রের এই পুনর্জাগরণ যারা হালকা কারণে আটকে দিতে চান, তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সৎ মনে হচ্ছে না। হতে পারে তারা প্রচার চাইছেন অথবা ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমা আটকাতে চাইছেন।
বন কমে যাচ্ছে বলে, বন্য প্রাণীর থাকার জায়গাও কমে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে তাদের সংখ্যাও। সেই দিকে আমাদের ততটা নজর নেই, যতটা ‘হাওয়া (২০২২)’র শালিকের দিকে নজর। এমনিতে বলা হয়, গল্পের গরু গাছে ওঠে। সিনেমায় আজগুবি অনেক কিছুই দেখানো হয়। তবে সিনেমা আবার জীবনের কথাও বলে।
আরও পড়ুন : ভাষা আন্দোলনকে নিছক জাতীয়তাবাদী মোচড়ে আমি দেখি না
বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে অনেকেই শখ করে খাঁচায় পাখি পোষেন। বড়লোকেরা অনেক দামি কেইজ বার্ড পুষলেও গ্রামের মানুষ টিয়া, ময়না, শালিক পোষেন। পায়রা পোষা নিয়ে তো রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়। যারা পোষেন, তারা ভালোবেসেই পোষেন। আদর করেন, খাওয়ান।
পৃথিবী সব প্রাণীর জন্য উন্মুক্ত, কথাটি শুনতে ভালো লাগলেও একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা কিন্তু তা অনুমোদন করে না। ঢাকার রাস্তায় কুকুর-বিড়ালের পাশাপাশি দুটি বাঘ আর সিংহকে আপনি হাঁটতে দেবেন? বন্যেরা বনেই সুন্দর। অ্যাক্টিভিস্টরা চিড়িয়াখানাও বন্ধ করে দিতে চান। প্রকৃতি-পশু ভালোবাসা আর চিড়িয়াখানা বন্ধ করে দেওয়া এক নয়।
দাবিটা হওয়া উচিত, চিড়িয়াখানায় যাতে প্রাণীদের কষ্ট দেওয়া না হয়, তাদের যেন ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয়, পশুর সাথে যেন নিষ্ঠুর আচরণ না করা হয়। যারা বাসায় অনুমোদিত পশু-পাখি পোষেন, তারা যেন তাদের যত্ন নেন। সেটা না করে, আমরা লাফাচ্ছি, সিনেমার একটি শালিক পোষা নিয়ে।
‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমার পরিচালকের বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছেন, সেই বন্য প্রাণী অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে বন ধ্বংসের অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন সময়ে। রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বন উজাড় করে দিয়েছে। তাদের চোখের সামনেই তো বন ধ্বংস হচ্ছে। দেশের বনসম্পদ রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য তাদের বিরুদ্ধেও কিন্তু শত শত মামলা হতে পারে।
আরও পড়ুন : টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ এবং বাস্তবতা
বলা হচ্ছে, ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমা দেখে মানুষ খাঁচায় পাখি পুষতে এবং খেতে উৎসাহী হতে পারে। আমি সমর্থন করছি না, আমি কখনো পুষিওনি, তবে খাঁচায় পাখি পোষা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের গল্প-কবিতা-গানে বারবার খাঁচার পাখির কথা বলা হয়েছে। খাঁচায় পাখি পোষার অনুপ্রেরণা পেতে ‘হাওয়া (২০২২)’ দেখার দরকার নেই।
খাঁচার পাখির চেয়ে মুক্ত পাখিই আমার বেশি প্রিয়। আমিও চাই সব পাখি মুক্ত থাকুক, উড়ে বেড়াক আকাশে। কিন্তু তাই বলে, ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমায় একটি শালিক খাঁচায় রাখায় মহাভারত উল্টে গেছে বলেও মনে করি না। এমন যদি হতো বাংলাদেশের কোথাও এখন আর পাখি পোষা হয় না, তাহলেও না হয় তাদের আপত্তি বা মামলা আমলে নেওয়া যেত। সিনেমা তো জীবন থেকেই নেওয়া। এই সিনেমা দেখে যদি মানুষ পাখি পুষতে অনুপ্রাণিত হয়; তাহলে তো সিনেমা থেকে হত্যা, ধর্ষণ, মারামারির দৃশ্য বাদ দিতে হবে।
সিনেমা দেখে যদি তরুণেরা প্রেমের মতো খারাপ বিষয় শিখে যায়, তাই সিনেমায় প্রেম-ভালোবাসাও দেখানো যাবে না। কোনো সিনেমায় কোনো ভিলেন থাকবে না, শুধু নায়ক থাকবে এবং নায়ক শুধু ভালো ভালো কথা বলবেন আর ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করবেন। বাস্তব জীবনে আমরা মারামারি, কাটাকাটি করব, খুন করব, প্রতিদিন নারীরা ধর্ষিত হবে; কিন্তু সিনেমায় সেগুলো দেখানো যাবে না।
আরও পড়ুন : প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক
তারচেয়ে বড় কথা হলো, ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমা তো পরিচালক বানিয়েই সরাসরি মুক্তি দিয়ে দেননি। বাংলাদেশে একটি সেন্সর বোর্ড আছে, তারা দেখেই সিনেমার ছাড়পত্র দিয়েছেন। অবশ্য সেন্সর বোর্ড আবার মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ আটকে রেখেছেন।
‘হাওয়া (২০২২)’র পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করলে, সেই মামলায় সেন্সর বোর্ডের সদস্যদেরও আসামি করতে হবে। মামলা যেহেতু হয়েছে, বিষয়টি এখন আদালতেই নিষ্পত্তি হবে। পারলে সেই শালিক পাখি ধরে এনে সাক্ষীও বানানো যায়!
তবে চলচ্চিত্রের এই পুনর্জাগরণ যারা হালকা কারণে আটকে দিতে চান, তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সৎ মনে হচ্ছে না। হতে পারে তারা প্রচার চাইছেন অথবা ‘হাওয়া (২০২২)’ সিনেমা আটকাতে চাইছেন। নইলে বাংলাদেশের সিনেমায় এরচেয়ে অনেক বেশি অসংবেদনশীল দৃশ্য দেখানো হয়েছে। হঠাৎ ‘হাওয়া (২০২২)’ নিয়ে এই অতি সংবেদনশীলতা সন্দেহজনক।
তবে আমার ধারণা, এই মামলা দিয়ে ‘হাওয়া (২০২২)’র গতি বন্ধ হবে না। বরং এই বিতর্ক আর মামলা ‘হাওয়া (২০২২)’র পালে জোর হাওয়া দেবে। ‘পরান (২০২২)’ আর ‘হাওয়া (২০২২)’য় বাংলা সিনেমায় যে জোয়ার এসেছে তা আরও বেগবান হোক।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ