ছবি : সংগৃহীত

স্বাধীনতার ৫০ পেরিয়ে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তির পথে বেশ খানিকটা এগিয়েছে বাংলাদেশ। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশ রেলওয়েতে এখনো নেই কোনো আইটি বিভাগ। নেই কোনো কর্মকর্তা।

এমনকি আইটি বিভাগের কোনো পদও এখন সৃষ্টি করতে পারেনি রাষ্ট্রীয় এই সেবা সংস্থা। অথচ ১৯৯২ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ রেলেই সর্বপ্রথম যুক্ত হয় কম্পোজিট ক্যাবল (অপটিক্যাল ফাইবার + কপার ক্যাবল) নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা।

রেলের বিশাল জমি কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা হয় বিশাল তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক। যার আওতায় ১৬০০ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার ভিত্তিক বিশাল ক্যাবল দিয়ে তৈরি করা হয় আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম, এজন্য কোনো টাকা নেয়নি নরওয়ে সরকার।

আরও পড়ুন : রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?

সেই সময় বিশ্বে এধরনের প্রযুক্তি সম্পন্ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয়। এশিয়ার কোনো দেশ এই প্রযুক্তি গ্রহণ করতে রাজি না হওয়ায় নরওয়ে সরকার বাংলাদেশকে তা ফ্রিতে দিতে আগ্রহ দেখায় কিন্তু দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের বিশাল সংখ্যক জমি না থাকায় কেউ এটা নিতে রাজি হয়নি কেননা মাটি খুঁড়ে নেওয়া হয়েছিল বিশাল এই ক্যাবল নেটওয়ার্ক।

পরবর্তীতে কপার ক্যাবল বাদ দিয়ে বসানো হয় শুধু ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল। যার মাধ্যমে রেলের নিজস্ব টেলিযোগাযোগ গড়ে ওঠে। এর মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ রেলের সকল টেলিযোগাযোগ ও সংকেতের কাজ। বর্তমানে এই ক্যাবল নেটওয়ার্কের পরিমাণ প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার। যার মাধ্যমে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির বিশাল এই গৌরবের ইতিহাস ৩০ বছর ধরে বহন করলেও নিজেরা আজও গড়ে তুলতে পারেনি একটা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। অথচ রেলের এই নেটওয়ার্ক ভাড়া নিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। গৌরবের রেলই এখনো চলছে ভাড়া করা প্রতিষ্ঠান দিয়ে।

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশ রেলওয়েতে এখনো নেই কোনো আইটি বিভাগ। নেই কোনো কর্মকর্তা। এমনকি আইটি বিভাগের কোনো পদও এখন সৃষ্টি করতে পারেনি রাষ্ট্রীয় এই সেবা সংস্থা।

নিজেদের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১৫ বছর আগে অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু করে রেল। নিজেদের কোনো আইটি বিভাগ না থাকায় ভাড়া করা লোকের উপর নির্ভর করেই প্রযুক্তির পথে হাঁটা শুরু করে রেল।

কাউন্টারে টিকিট বিক্রির যে সার্ভার সেটা পর্যন্ত ভাড়া করা প্রতিষ্ঠানের। ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানকে। টিকিট নিয়ে অনেক অভিযোগ, কালোবাজারির দখলদারিত্ব এসব চললেও নিজেদের কোনো যোগ্যতা না থাকায় এসব মেনে নিয়েই চলেছে রেল।

আরও পড়ুন : রেলের টিকিট কালোবাজারি : টিকিট যার ভ্রমণ তার

টিকিট নিয়ে নৈরাজ্য এখনো চলছে। অথচ দীর্ঘ ১৫ বছরে নিজেদের লোকবল তৈরির কোনো উদ্যোগই নেয়নি রেল। টেকনিক্যাল লোক নিজেদের না থাকায় আজও অন্যরা যা বোঝাচ্ছে রেল কর্মকর্তারা তাই বুঝছেন। অন্যদিকে যাত্রীদের অবস্থা বেহাল।

বর্তমানে যে প্রতিষ্ঠান অনলাইনে টিকিট বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ থাকলেও তা নিয়ে রেল কর্তারা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না, কেননা এই সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই।

শুধু টিকিটই নয় কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় কেনাকাটা থেকে শুরু করে মালামাল মজুদ ও সার্বিক হিসাব নিকাশ করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে বলা হচ্ছে বারবার অথচ রেল এখনো মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের বেতন দেয় হ্যান্ডক্যাশে। এই হলো বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য প্রযুক্তিগত সক্ষমতা।

আরও পড়ুন : রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত?

পিছিয়ে পড়া রেলের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে নেওয়া হয়—ইআরপি বা এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং প্রকল্প। প্রকল্প সমাপ্ত হয় ২০১৫ সালে। এই প্রকল্পের আওতায় কেনা হয় একটি ইআরপি সফটওয়্যার। যেখানে ছয়টি সেক্টরে রেলের কর্মকর্তারা কাজ করতে পারার কথা। যেমন—রেলের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা, হিসাব বিভাগ, ওয়ার্কশপ ব্যবস্থাপনা, মালামাল সংরক্ষণাগার, প্রকল্প ও প্রশিক্ষণ।

এসব বিভাগ যে সফটওয়্যার ব্যবহার করে তার দাম ছিল ৩৪ কোটি টাকা। এর সাথে কেনা হয় দুটি সেন্ট্রাল ডাটা সংরক্ষণাগার সার্ভার। একটি সার্ভার বসানো হয় ঢাকার কমলাপুর বিভাগীয় রেলের পরিবহন ভবনে। উদ্দেশ্য সফটওয়্যারের সকল তথ্য সংরক্ষণ করা হবে এই সার্ভারে। আর মূল সার্ভার যদি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সব তথ্য যেন ব্যাকআপ থাকে তাই আরেকটি সার্ভার স্থাপন করা হয় রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের টেলিযোগাযোগ ও সংকেতের তথ্যানুযায়ী, সফটওয়্যার কিনতে খরচ হয় ৩৪ কোটি টাকা, ডাটা সার্ভার ২২ কোটি টাকা, ট্রান্সমিশন লজিক্যাল সার্ভার ও অন্যান্য ৪০ কোটি টাকা মোট ৯৬ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন : রেল যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে 

৯৬ কোটি টাকা খরচ করে সাত বছরে একদিনের জন্যও চালু করা সম্ভব হয়নি সেই সফটওয়্যার। বর্তমানে তা আর ব্যবহার করা হয় না, বরং তা যেন হারিয়ে গেছে। রেলের কোনো কর্মকর্তাই এর অস্তিত্ব দেখাতে পারবেন না।

যেহেতু সফটওয়্যারই চালু করা সম্ভব হয়নি, তাই বন্ধ করে রাখা হয়েছে সার্ভার দুটিও। নষ্ট হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান যন্ত্রপাতি। ধুলা ময়লা পড়ে সব যন্ত্রই বিকলের পথে। ইতিমধ্যে বিকল হয়ে গেছে বেশিরভাগই।

বাংলাদেশ রেলওয়ের টেলিযোগাযোগ ও সংকেতের তথ্যানুযায়ী, ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে এসবের মেয়াদকাল। মানে এত টাকায় কেনা যন্ত্রপাতি চালু করার আগেই মেয়াদ শেষ। মানে এই প্রযুক্তি আর কখনোই ব্যবহার হবে না।

৯৬ কোটি টাকা খরচ করে সাত বছরে একদিনের জন্যও চালু করা সম্ভব হয়নি সেই সফটওয়্যার। বর্তমানে তা আর ব্যবহার করা হয় না, বরং তা যেন হারিয়ে গেছে। রেলের কোনো কর্মকর্তাই এর অস্তিত্ব দেখাতে পারবেন না।

রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্প নেওয়াই ভুল ছিল। কেননা নিজেদের কোনো তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এমনকি একটা পদও না থাকার পরও নেওয়া হয়েছিল এই প্রকল্প। সুতরাং তা আর আলোর মুখ দেখেনি। মানে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান যে কাজ করে দিয়েছে তা ঠিকমতো হলো কি না তা যাচাই করার লোক না থাকা সত্ত্বেও এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল বলে মত দিচ্ছেন রেলের কর্মকর্তারা।

অথচ এই প্রকল্প নেওয়ার সময় এর সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প ছিল, সেখানে এর ভালোমন্দ দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর আর্থিক লাভ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নিজেদের সক্ষমতা নেই জেনেও এই প্রকল্পের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। এখন এর দায় নেবে কে?

আরও পড়ুন : পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি

নষ্ট সফটওয়্যার আর সার্ভার নতুন করে কীভাবে চালু করা যায়? অথবা এটা কাজে লাগবে কি না তা যাচাই করার জন্য আরও একটি প্রকল্প নিতে যাচ্ছে রেলওয়ে। মালামালগুলো কোন অবস্থায় আছে? এগুলো আর ব্যবহার উপযোগী আছে কি না এসব জানতে নতুন প্রকল্প নেওয়া হবে দেশ সেরা তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের দিয়ে, ফলে সেখানেও খরচ হবে টাকা।

কতটা নির্লজ্জ হলে একটা প্রতিষ্ঠান কোনো প্রকার বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থের এমন অপচয় করতে পারে। রেলের অনেক কর্মকর্তাই বলছেন, প্রকল্পের আওতায় কেনা প্রযুক্তি ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে সেগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে চালু করেও লাভ হবে না। কেননা, এই প্রযুক্তি আর বিশ্বের কোথাও ব্যবহার করা হচ্ছে না।

তার মানে হলো, এসব ফেলে দিয়ে নতুন করে আরও একটি প্রকল্প নেওয়ার কথা ভাবছে রেলওয়ে। যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ আছে বিভিন্ন কারণে রেলকে ডিজিটালাইজেশনের পথে হাঁটতেই হবে। শোনা যাচ্ছে, এসব পুরোনো প্রযুক্তির সবকিছু জলে ফেলে দিয়ে আরও আপডেট ভার্সনের নতুন একই রকম আরও একটি প্রকল্প নেওয়ার কথা ভাবছে রেল।

আরও পড়ুন : ট্রেনের জানালায় পাথর ছোড়ে কেন?

এবার সেই প্রকল্পে খরচ হতে পারে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। অথচ সেই প্রযুক্তি ব্যবহার তো দূরের কথা তা পাহারা দেওয়ার মতো প্রযুক্তিকর্মীও নেই রেলে। তাহলে সেই প্রকল্প নিয়ে লাভ কী?

এসব রেলের কোন বিভাগের অধীনে থাকবে তা নিয়ে চলছে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, কেননা রেলের এই সংক্রান্ত কোনো বিভাগই নেই। তাহলে বিশাল অঙ্কের টাকায় নতুন প্রকল্প যদি নেওয়াও হয় তা যদি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখার মতো লোকও না থাকে তাহলে সেই প্রযুক্তি দিয়ে কী হবে?

দশ বছরে রেল উন্নয়নে খরচ করেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। চলছে ৪২টি উন্নয়ন প্রকল্প, যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের রেলে আইটি খাতে নেই কোনো প্রকল্প।

নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো টিকিট বিক্রির সার্ভার কেনার উদ্যোগও নেই তাদের। প্রযুক্তির এই সময়ে এর চেয়ে লজ্জা আর কী হতে পারে? আমার মনে হয় রেলই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রধান অন্তরায়।

নাজমুস সালেহী ।। গণমাধ্যমকর্মী
nazmussalehi@gmail.com