পৃথিবীর উষ্ণতম অঞ্চলের দেশে মশাবাহিত রোগে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর বড় আঘাতের পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়।

রোগীর সংখ্যা বিচারে বছর ভেদে কম বেশি হয়। তবে প্রায় প্রতিবছরই দেখা যায়, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সরকারি পরিসংখ্যানে, রোগীর যে সংখ্যা দেখানো হয় তা ঢাকার মাত্র ৪৭টি হাসপাতাল ও অন্যান্য জেলার অল্পকিছু হাসপাতালের তথ্য।  এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০গুণ।

আবার অসংখ্য রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষা করে বাসায় চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। প্রতিবছর প্রায় একই সময়ে ডেঙ্গু আঘাত হানছে আর আমরা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। আর কতকাল আমাদের ডেঙ্গু নিয়ে বসবাস করতে হবে?

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন?

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে মানুষ। ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে এই সতর্কবার্তা আমি ২০২২ সালের জুনের শুরুতেই দিয়েছিলাম এবং বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা প্রচারিত হয়েছে।

ঢাকায় এডিস মশার বর্তমান ঘনত্ব ডেঙ্গু ছড়ানোর উপযোগী মাত্রায় রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে হাজার হাজার মানুষ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা হিসাব করলে দেখা যায়, ঢাকা ডেঙ্গুর জন্য সবচেয়ে বড় হটস্পট। কিন্তু আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এটি ঢাকা থেকে বিস্তৃত হচ্ছে অন্য জেলায়।

প্রতিবছর প্রায় একই সময়ে ডেঙ্গু আঘাত হানছে আর আমরা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। আর কতকাল আমাদের ডেঙ্গু নিয়ে বসবাস করতে হবে?

২০২২ সালের মে মাসের শুরুতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মশার গবেষণায় আমরা ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি মশার ঘনত্ব উদ্বেগজনক মাত্রায় দেখতে পাই। তখনই আমি বলেছিলাম, ২০২২ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। সেটিই হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং এই রোগ এখন কক্সবাজারে বিস্তৃত হয়েছে।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধ হবে কবে? 

বছরের শুরু থেকে হাসপাতালে ভর্তির রোগীর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অল্প কয়েকটি হাসপাতালে সবসময় রোগীর সংখ্যা বেশি। এই হাসপাতালগুলোর মধ্যে মুগদা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বেশি থাকা নির্দেশ করে যে, কোনো কোনো বিশেষ এলাকা ডেঙ্গু রোগের হটস্পটে রূপান্তরিত হয়েছে এবং আমরা একে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছি। আর এই হটস্পটগুলো থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী এলাকায়।

কোনো এলাকায় যখন হঠাৎ করে রোগ বেড়ে যায় তখন সেই রোগের কারণ অনুসন্ধান করতে হয়।

আরও পড়ুন : এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ : করণীয় কী?

রোগ বিস্তারের কারণগুলো যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায় তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। এই কারণ চিহ্নিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তত্ত্বাবধানে ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. একরামুল হকের নেতৃত্বে আমরা একটি দল নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাই। সেখানে ১৪ দিনের গবেষণা শেষে আমরা দেখতে পাই ডেঙ্গু প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি মশার উচ্চ ঘনত্ব।

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বেশি থাকা নির্দেশ করে যে, কোনো কোনো বিশেষ এলাকা ডেঙ্গু রোগের হটস্পটে রূপান্তরিত হয়েছে এবং আমরা একে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছি।

ডেঙ্গু রোগের প্রধান বাহকের ঘনত্ব কেন এত বেড়ে গেল তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নেই। তাই ক্যাম্পে বসবাসকারী লোকজন বিভিন্ন পাত্রে পানি জমিয়ে রাখছে এবং এই পাত্রগুলোতে এডিস মশার বংশবিস্তার করছে। যার কারণে বেড়ে গিয়েছে এডিস মশার ঘনত্ব। এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে সেখানে এবং সেখান থেকে তার আশেপাশের এলাকায়ও বিস্তৃত হচ্ছে এই রোগ।

আরও পড়ুন : মশা কেন রক্ত খায়?

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ সঠিক সময়ে করতে না পারার কারণেই পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ডেঙ্গু এপিডেমিক হতে চলেছে। বর্তমানে ঢাকার বাইরে জেলাগুলোতে যত রোগী আছে তার প্রায় ৮০ শতাংশ কক্সবাজার শহরে। ঢাকার পরবর্তী নগর হিসেবে কক্সবাজারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

কোনো এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে হটস্পট ম্যানেজমেন্ট করতে হয়। ডেঙ্গু রোগীর বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে প্রতিটি বাড়ির চতুর্দিকে ফগিং করে উড়ন্ত মশা মারা নিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনোভাবেই ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা অন্য কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?

ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হাসপাতালগুলোর চতুর্দিকে নিয়মিত ফগিং করতে হবে যাতে সেখানে কোন এডিস মশা বেঁচে না থাকে। হাসপাতাল এবং বাড়িতে থাকা যেকোনো ডেঙ্গু রোগী সবসময় মশারির নিচে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আগামী দুটি মাস হটস্পট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি মশার প্রজনন স্থল ধ্বংসের কার্যক্রমও চালাতে হবে। এই কাজে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে।

আরও পড়ুন : মশার উৎপাত : রোগ বিস্তারের আশঙ্কা কতখানি? 

ঢাকার মতো ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন অন্য শহরেও খারাপ না হয় সেই বিষয়ে প্রত্যেক নগর পিতাদের সজাগ দৃষ্টি এবং নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ করতে পারলে ডেঙ্গু সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। সিটি করপোরেশন ও নগরবাসীর সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে ডেঙ্গু সমস্যার একটি টেকসই স্থায়ী সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করি।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়