বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল সরকার-সেনাবাহিনীকে নাড়িয়ে দেওয়া
৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন মানচিত্র পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে এরপর থেকে নানা ষড়যন্ত্র, নীলনকশায় বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। তেমনি একটি বেদনাবিধুর কলঙ্কিত দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি। ২০০৯ সালের এই দিনে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত হয় নির্মম হত্যাকাণ্ড। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর বিদ্রোহের অবসান হলেও পিলখানা পরিণত হয় রক্তাক্ত প্রান্তরে। উদ্ধার করা হয় অসংখ্য সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।
ওই ঘটনার ১২ বছরের মাথায় এসে পেছনে ফিরে তাকালে অনেকগুলো প্রশ্ন তাড়া করে। এই কলঙ্ককে পেছনে ফেলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সুরক্ষা-নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে সেটাও এখন আলোচনায় উঠছে।
বিজ্ঞাপন
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা ছিলেন, কেন আগে থেকে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানা যায়নি এসব নিয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হন নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন।
ঢাকা পোস্ট: ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। তেমনি একটি পিলখানা হত্যাকাণ্ড। আজ পিলখানা হত্যাকাণ্ডের এক যুগ। অথচ আজও জানা যায়নি ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কারা?
মোহাম্মদ আলী শিকদার: ঢাকা পোস্টকে ধন্যবাদ। যথার্থ প্রশ্নই করেছেন। আমাদের নিজেদের স্বার্থে এই ধরনের ষড়যন্ত্র-হত্যাকাণ্ড থেকে মুক্তির উপায় বের করতে হবে।
দেখুন, সম্মুখ সারিতে যারা ছিলেন, এমন কিছু ব্যক্তিই কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে। ওই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে দেশের ও দেশের বাইরের কিছু ব্যক্তি জড়িত ছিল। কারা জড়িত ছিল সেটা বিচার-বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে। এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যারা রাজনৈতিক সুবিধা পাবেন তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে। রাজনৈতিক সুবিধা আসলে কারা নিয়েছে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। তেমনিভাবেই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হচ্ছে পিলখানা হত্যাকাণ্ড।
ঢাকা পোস্ট: কেন সংগঠিত হয়েছিল পিলখানা হত্যাকাণ্ড? এতে আসলে কারা লাভবান হবার চেষ্টা করেছিল?
মোহাম্মদ আলী শিকদার: ব্যাপক মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ কিছু জনপ্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তারা বলেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার হবে, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচার হবে। ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলোতে যারা সশস্ত্র বিদ্রোহ চালায় তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় বাংলাদেশ দেবে না। এমন প্রতিশ্রুতিশীল একটি দল যখন ক্ষমতায় আসলো তখন যারা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত ভাবতে শুরু করেছিল তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। ওই ষড়যন্ত্রের অংশ হচ্ছে পিলখানা হত্যাকাণ্ড।
নির্বোধ নয়, জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন পরিপক্ব মানুষ মাত্রই বুঝবেন যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের কৃত পাপ মোচনের নিয়মতান্ত্রিক কোনো পথ খোলা নেই। তখন তারাই ষড়যন্ত্র করে। সশস্ত্র বিদ্রোহ আগেও হয়েছে। ১৯৯৪ সালে আনসার বিদ্রোহ হয়েছে। কিন্তু কখনো সশস্ত্র বিদ্রোহের পেছনে শুধু দাবি-দাওয়া আদায় মুখ্য ছিল না।
প্রতিশ্রুতিশীল একটি দল যখন ক্ষমতায় আসলো তখন যারা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত ভাবতে শুরু করেছিল তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। ওই ষড়যন্ত্রের অংশ হচ্ছে পিলখানা হত্যাকাণ্ড।
তারাই ষড়যন্ত্র করেছে যারা রাজনৈতিকভাবে অস্তিত্বের সংকট দেখেছে। এখানে সেনা জোয়ানরা ব্যবহৃত হয়েছে। জোয়ানদের ষড়যন্ত্রের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞান থাকার কথা নয়। তাদেরকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট: এ ধরনের বিদ্রোহ বা ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তির উপায় কী?
মোহাম্মদ আলী শিকদার: পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রই একটি জায়গায় কিন্তু একমত, সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ ঠিক রাখা। রাজনীতি থাকবে। সরকার বিপক্ষ থাকবে।
আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রাম করেছি, ৯ মাস যুদ্ধ করেছি। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে যে মৌলিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা কিন্তু সামরিক আইন দ্বারা বদলানোর চেষ্টা দেখেছি। সেটা আসলে বাতিল করা যায় না। সুতরাং ষড়যন্ত্র ঠেকাতে হলে রাজনীতির জায়গায় আমাদের গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। বহুদল থাকবে। কিন্তু মৌলিক আদর্শ ঠিক রাখা গেলেই কেবল এই ধরনের ষড়যন্ত্রের পথ রোধ করা সম্ভব। নইলে মুক্তি সম্ভব না।
ঢাকা পোস্ট: বিডিআর বিদ্রোহ হচ্ছে! কেন আগে থেকে বোঝা যায়নি, এই ব্যর্থতায় দায়ী কারা?
মোহাম্মদ আলী শিকদার: পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। তা পূর্ব থেকে জানতে না পারা ভয়ানক ব্যর্থতা, সীমাহীন ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা শুধু ব্যর্থতা বলা যাবে না। তদন্ত করা উচিত ছিল এটি শুধুই ব্যর্থতা নাকি ষড়যন্ত্রের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এটা তো হঠাৎ করে ঘটেনি বা আকস্মিক পরিকল্পনার অংশ নয়। দীর্ঘদিন ধরে এটা নিয়ে পরিকল্পনা হয়েছে। গোয়েন্দারা কেন বিষয়টি জানতে পারেননি সেই বিষয়টি অস্পষ্ট। কিন্তু আরও তো গোয়েন্দা সংস্থা ছিল, তাহলে তারা কী করেছে? এটা কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়াতেও জানা গেলো না। নেপথ্যে থেকে কারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন তাদের পরিচয় অজানাই থেকে গেল। আগামীতে এই অপরাধীদের শনাক্ত করতে না পারার বিষয়টি উদাহরণ থেকে গেল। এটি ভবিষ্যতের ষড়যন্ত্রকে উৎসাহিত করতে পারে। এই গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি তদন্তে আসা উচিত ছিল।
ঢাকা পোস্ট: বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে কিছু কারণ বা দাবি-দাওয়ার কথা শোনা যায়। সেগুলো কী নেহায়েত দাবিই ছিল?
মোহাম্মদ আলী শিকদার: বিদ্রোহের সুস্পষ্ট কারণ বিচারিক প্রক্রিয়ায় আসেনি। সেটা কিন্তু তদন্তগত ব্যর্থতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাল-ভাত কর্মসূচিতে দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু সেটার জন্য বা নেহায়েত দাবি-দাওয়ার জন্য বিদ্রোহ হয়নি। এই বিদ্রোহে অফিসারদের বাসভবনে হামলা হয়েছে। যা নজিরবিহীন। এর কারণ হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পড়েছিলেন সম্মুখ সারির জোয়ানরা। উদ্দেশ্য ছিল, চরমভাবে সরকার ও সেনাবাহিনীকে নাড়িয়ে দেওয়া। ভয়ানক উত্তেজনা সৃষ্টি করা। চরম উত্তেজনার মধ্যে সরকার ও সেনাবাহিনী যেন একটা কঠোর সিদ্ধান্তের দিকে যায়, সেইদিকে ধাবিত করা। যাতে করে বড় বিপর্যয় ঘটে। তাতে যেন বলা যায়, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো যোগ্যতা নেই। যদিও সেটা ষড়যন্ত্রকারীরা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
ঢাকা পোস্ট: পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সন্তুষ্টি কতটুকু?
মোহাম্মদ আলী শিকদার: বিচারিক আদালত রায় দেন ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। আর হাইকোর্টের রায় আসে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর। মামলার আয়তন অর্থাৎ একটি মামলায় এতো সংখ্যক আসামি ও সাক্ষী নজিরবিহীন ঘটনা। হাইকোর্টের রায় অনুসারে ১৩৯ জন মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জন যাবজ্জীবন এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পেয়েছে ২০০ জন। যথোপযুক্ত বিচার তো হয়েছেই, তার সঙ্গে নিহতদের স্বজনরা রাষ্ট্রসহ সর্বশ্রেণির মানুষের পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত সহানুভূতি, ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়েছে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। তা পূর্ব থেকে জানতে না পারা ভয়ানক ব্যর্থতা, সীমাহীন ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা শুধু ব্যর্থতা বলা যাবে না। তদন্ত করা উচিত ছিল এটি শুধুই ব্যর্থতা নাকি ষড়যন্ত্রের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এটা তো হঠাৎ করে ঘটেনি বা আকস্মিক পরিকল্পনার অংশ নয়।
পুরো বিচারিক প্রক্রিয়া সন্তুষ্ট হবার মতো। ভবিষ্যতে উদাহরণ সৃষ্টি করার মতো বিচার হয়েছে। ৯ বছরের মাথায় এমন একটি ঘটনার বিচার পাওয়া কিন্তু দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে নিঃসন্দেহে।
ঢাকা পোস্ট: পিলখানা হত্যাকাণ্ডের রায়ের কার্যকারিতায় আরও দেরির আশঙ্কা রয়েছে কিনা?
মোহাম্মদ আলী শিকদার: দেরিতে বিচার শেষ হবার শঙ্কা দেখছি না। তবে যদি আরও দেরি হয় তাহলে উদাহরণ সৃষ্টি হবার যে গুরুত্ব সেটা কমে যাবে, এই বিচারের প্রভাব কমে যাবে। হাইকোর্টের রায় হওয়ার দুই বছর হয়ে গেছে। আপিল বিভাগের হেয়ারিংটা শুরু বা শেষ হওয়া এতোদিনে উচিত ছিল। তাহলে পাকাপোক্ত হতো বিচারিক উদাহরণ।
ঢাকা পোস্ট: আপনাকে ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।
মোহাম্মদ আলী শিকদার: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদারের পরিচয়:
জন্ম: ১৩ মার্চ ১৯৫৫, গোপালগঞ্জের সদর উপজেলা।
আট-ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
১৯৭৫ সালের শেষের দিকে এইচএসসি’তে অধ্যয়নকালেই সেনাবাহিনীতে কমিশন অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনে জাতিসংঘ মিশন এবং বিকেএসপি’র ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালে আর্মি হেডকোয়ার্টারে দায়িত্ব পালন করেন। সেসময়ই তিনি মেজর জেনারেল পদ থেকে অবসরে যান। অবসরের পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও বেসরকারি গণমাধ্যম একুশে টেলিভিশন’র এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেশীয়-আঞ্চলিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে নিয়মিত লেখালেখি করেন।
জেইউ/বিডি