ছবি : সংগৃহীত

দুই দিন আগে সন্ধ্যাবেলা ঢাকার বারডেম হাসপাতাল। আইসিইউর সামনে কিছুটা ভিড়ে ঠাসা খালি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আমার এক বন্ধুর মুমূর্ষু মায়ের আপডেট পাওয়ার জন্য। পৃথিবীর যেকোনো মা-ই সবার মা। তিনি ধর্ম-বর্ণ বা চেনা-জানা না থাকুক বা না মিলুক। এখানে এটি কোনো মুখ্য বিষয় হওয়ার কথা নয়।

সেই মায়ের অসুখের খবর যে কাউকেই বিচলিত করে। ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। আমাকেও করেছে। তাইতো আমাদের এই বন্ধুর অসুস্থ মাকে দেখার জন্য খবর পেয়ে আমিও নিজের মা মনে করেই তৎক্ষণাৎ ছুটে গেছি হাসপাতালে। তার নিজের সন্তানের মতো হয়তো নয়, কিন্তু আমিও আমার হৃদয়ের আদতে বিচলিত হয়েছি।

ভীষণ টেনশনে পড়েছিলাম। বন্ধুর কান্না দেখে ভেতরে ভেতরে কেঁদেছি। সেটা হয়তো কেউ দেখতে পায়নি। দেখানো সম্ভব নয়। ঈশ্বরের কাছে সম্ভব দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছি। প্রার্থনা করেছি অবিরত।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা, পরম্পরায় বাংলাদেশ 

নীরবে আইসিইউর পাশে বসে এখানে-সেখানে অপেক্ষা করেছি, কখন ভালো খবর আসবে। ডাক্তার ভালো খবর জানাবে। কষ্টে আমারও বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। তার নিজের সন্তানের মতোই নিঃশব্দে আহাজারি করেছি। সেটি কিন্তু কেউ দেখতে পায়নি। পাওয়ার কথাও না।  আমি যে তার নিজের সন্তানদের কাছে একজন আগন্তুক মাত্র। পরের কেউ। আত্মীয়স্বজনেরা কেউ আমাকে চেনেন না। তারপরও মা। কথাগুলো এখানে বলার একটি উদ্দেশ্য আছে বটে।

আমি যখন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবকে নিয়ে কিছু একটা লেখালেখি করছি ঠিক যেই সময়টাতেই খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আমি আমার বন্ধুর মাকে দেখতে চলে গেছি বারডেম হাসপাতালে। তাইতো বিষয়টি কাকতালীয় হলেও হাসপাতালেই বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার কথা তখন আমার বারবার মনে হচ্ছিল।

বন্ধুর মা যেমন আমার মা। বঙ্গমাতাও আমারই মা। জাতির মা। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব বাঙালি জাতির গর্ব এবং নারীদের অনুপ্রেরণার উৎস। তার ত্যাগ, মমতা, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতার কারণে তিনি বঙ্গমাতা হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : ৫০ বছরে কতটা অর্জিত হলো?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেন, পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা, শক্তি ও সাহস জোগাতে বঙ্গমাতা অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।

সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত না থেকেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস ছিলেন বেগম মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি জাতির পিতার পাশে থেকে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন।

তার কর্মের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন একটি সংগ্রাম মুখর জীবনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যে জীবন কোটি জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের সাথে দ্বিধাহীনভাবে যুক্ত হয়েছিল ত্যাগ ও নিপীড়ন মোকাবিলা করার দৃপ্ত প্রতিজ্ঞায়।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধুর চেতনায় বাংলাদেশ 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের স্মৃতি কথা থেকে জানা যায়, তিনি নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতেন। বঙ্গমাতার হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগও হয়েছিল তার। কিন্তু ১৯৭৪ সালে যখন দেশে বন্যা হচ্ছে, সেই রকম একদিনে ওই বাড়িতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘এখানে কী? মানুষ কষ্ট করছে, মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াও।’

এই আদর্শ নারীর জীবন থেকে এখনকার মেয়েদের অনেক কিছু শেখার আছে যেখানে মায়ের মমতা ও নেতার মতো আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা দুটোই আছে।

একজন মা হলেন আমাদের সবচেয়ে সত্যিকারের বন্ধু, যখন আমাদের উপর কঠিন এবং হঠাৎ করে পরীক্ষা আসে; যখন প্রতিকূলতা সমৃদ্ধির স্থান নেয়, যখন বন্ধুরা আমাদের ছেড়ে চলে যায়, যখন আমাদের চারপাশে সমস্যা ঘনীভূত হবে, তখনো তিনি আমাদের আঁকড়ে থাকবেন।

আরও পড়ুন : তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

অন্ধকারের মেঘ দূর করতে এবং আমাদের হৃদয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে তার সদয় উপদেশ ও পরামর্শের মাধ্যমে চেষ্টা করবেন। বঙ্গমাতাও তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, মানসিকতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা; প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তাইতো তিনি মা। সবারই মা।

বঙ্গমাতার ফজজিলাতুন্নেসা মুজিব তার সামগ্রিক জীবনাচরণের মধ্যে ধারণ করে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, রাজনৈতিক জীবন এবং যাপিত জীবনকে। সেই জন্যই তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিতে পেরেছিলেন একজন লড়াকু আদর্শ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটানো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের সব চাওয়া-পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কণ্টকাকীর্ণ পথে তার অবদান ও গুরুত্ব অপরিসীম তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। তার সুমহান ব্যক্তিত্ব ও অপরিসীম ত্যাগের সাথে পরিচয় ঘটানোর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশমাতৃকার প্রতি নির্মোহ চিত্তে আত্মনিবেদনের তাড়নাকে জাগ্রত করার প্রত্যয়ে মহীয়সী এই জননীর জন্মদিনে আমাদের কৃতজ্ঞ চিত্তের অশেষ শ্রদ্ধা।

বারডেম হাসপাতালে বন্ধু মনিরার মায়ের সুস্থতার অপেক্ষায় ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আব্রাহাম লিংকনের সেই কথাটিই বারবার মনে হচ্ছিলো, কোনো মানুষই দরিদ্র নয় যার একজন ঈশ্বরীয় মা আছে।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
babul@hotmail.com