সাদা সাদা কালা কালা
মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্র দেশের বিভিন্ন সিনেমা হলে চলছে। দর্শকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখার মতো। তার আগে ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেন কি? বসন্ত কালে তোমায় বলতে পারিনি’ এই গানটি মুক্তি পেয়েছিল।
গান মুক্তির পর থেকেই পুরো বাংলাদেশ যেন এই গানের জোয়ারে ভাসছে। ভাবা যায়, একটা যথার্থ সুর ও সংগীত কতটা শক্তিশালী হতে পারে যে, একটা সমগ্র জাতিকে ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরিব নির্বিশেষে এক বিন্দুতে একত্রিত করতে সক্ষম।
বিজ্ঞাপন
সুর এবং সংগীত হচ্ছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে পুরাতন আবিষ্কার। ধারণা করা হয়, আগুন আবিষ্কারেরও বহু আগে এই সুর আবিষ্কার হয়েছিল। মূলত আদি প্রকৃতিই এই সুর ও সংগীত সৃষ্টির সবচেয়ে বড় কারিগর।
আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?
‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ এই গানেও কোনো আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি সব বাদ্যযন্ত্রই এখানে অর্গানিক। যার ফলে গানের মাঝে এক অন্য রকম অনুভূতি রয়েছে যার কারণে মানুষ আদি আকর্ষণ অনুভব করছে।
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সুর, সংগীত এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে এই ধারাকে রুদ্ধ করে দিতে চায়। তারা জানে না যে, সুর এবং সংগীত হচ্ছে মানুষের শরীরে প্রকৃতি প্রদত্ত, সেই ধারা যা মানুষের হৃদয়ের মননে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো লেপটে আছে। যা চাইলেই কেউ পৃথক করতে পারবে না।
পারস্যের কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমির সুর এবং সংগীত সম্পর্কে বলেন, ‘যখন আমার কাছে স্রষ্টাকে পাওয়ার আর কোনো পথ অবশিষ্ট থাকবে না তখন আমি এই সুর এবং সংগীত বেছে নিব, এই পথে তাকে ডাকলে সে অবশ্যই দর্শন দিবে’। তিনি আরও বলেন, ‘আমার সমাধিতে কেউ যেন সুর, সংগীত এবং ঢোল ছাড়া না আসে’।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘আমি শুধুমাত্র ভাষা দিয়ে ভগবানকে যতখানি পাই তারচেয়ে বেশি পাই সেই ভাষার সাথে সুরের সংযোগ ঘটিয়ে’। সংস্কৃতি এবং অপসংস্কৃতি এই দুইয়ের হ্রাস-বৃদ্ধি আমাদের বাস্তুসংস্থান চক্রের মতো ঘূর্ণায়মান। বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের সমাজে যখন মাঠের সংখ্যা কমে গেছে তখন ছেলেমেয়েরা মাঠ ছেড়ে মোবাইল গেইমে আসক্ত হয়েছে।
আবার যদি খেলার মাঠ তৈরি করে খেলার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় তাহলে আবার ছেলেমেয়েরা মোবাইল গেমের রোবটিক পৃথিবী ছেড়ে প্রাকৃতিক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবে।
আরও পড়ুন : এখন তাহলে কোন জীবন থেকে নেবেন?
একটি গান যেমন মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারে তেমনি একটি মাঠও মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারে। নবীনদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে একটি ভালো খেলার মাঠের কোনো বিকল্প নেই। তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঠিক সাংস্কৃতিক চর্চারও কোনো অপরাপর উপায় নেই।
আমাদের এই তারুণ্যের রোবটিক চিন্তাকে সার্জারি করে প্রাকৃতিক করে তুলতে হবে আর সেই শল্য চিকিৎসক হতে পারে আমাদের এই সঠিক সাংস্কৃতিক চর্চা।
বাঙালির জীবনযাত্রায় সংস্কৃতি সম্যক চর্চা রূপে না হয়ে প্রদর্শন ও নিদর্শনের চিহ্ন রূপে পরিলক্ষিত হয় বলে তা লোকান্তরের যোগসূত্রের ভগ্নদশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সুর এবং সংগীত হচ্ছে, মানব সভ্যতা ও বিবর্তনবাদের সেই আদি রস যা হোমো স্যাপিয়েন্স প্রণয় এবং প্রতিরক্ষার ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে আজকের এই আধুনিক মানব সভ্যতায় দাঁড় করিয়েছে।
আরও পড়ুন : তারেক মাসুদ : স্বপ্নদ্রষ্টা, আলোকবর্তিকা
একটি শঙ্খের শব্দে যেমন সমুদ্র লুকিয়ে থাকে, এক ফোঁটা রক্তের কোটি ভাগের এক ভাগের মধ্যে যেমন মহীরুহ লুকিয়ে থাকে তেমনি এই সুর এবং সংগীতের মাঝে মানব সভ্যতার আদি ইতিহাস লুকায়িত রয়েছে।
প্রাচীন আমেরিকার সুসভ্য সমাজের প্রধান আরাধ্য সূর্য। পূজারিরা মনে করতো সূর্য দেবতা সর্বদা রাগান্বিত থাকে আর তাকে তুষ্ট করার জন্য সংগীত ছাড়া কোনো দ্বিতীয় পন্থা নেই। এভাবেই তারা সূর্য দেবকে তুষ্ট করতো। দগদগে দূষিত ঘায়ের মতো যে অপসংস্কৃতি আমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে তা রুখে দেওয়ার জন্য নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের সাত রাজার ধনের মতো রয়েছে বিপুল নিজস্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পুঁথি সাহিত্য, লোকগীতি, মঞ্চ নাটক, পথ নাটক, গীতি কাব্য, চর্যাগীতি, বাউল গান, লালন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম যা শুধুই আমাদের।
আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় আজ বিলুপ্তির পথে আমরা এখন এমন এক মিশ্র সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি যা আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হুমকির মুখে।
আরও পড়ুন : সালমান শাহ : চলচ্চিত্রের স্টাইলিশ আইকন
আমাদের ভূলুণ্ঠিত হওয়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরায় প্রতিষ্ঠাই এখন পারে ভোঁতা হয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক অবস্থাকে জাগ্রত করতে। আমাদের একটা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার যে বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা আশাহত আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংস্কৃতির ভাঙা সেতু আবার মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করে তুলতে পারি।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এই হাওয়া সর্বদা বিরাজ করুক অবিরাম বাংলার পথে প্রান্তরে। গানের ভেতরে বসন্ত কালে বলতে না পারার যে অপ্রাপ্তি, আক্ষেপ রয়েছে সিনেমার মাধ্যমে যেন সেই প্রাপ্তি ঘটে। হাওয়া বয়ে যাক অবিরাম।
কাজী বনফুল ।। সাবেক শিক্ষার্থী