অমিত হাবীব : বার্তা কক্ষের নেতা
Innovation distinguishes between a leader and a follower—স্টিভ জবস-এর এই কথাটি খুব আলোচিত হয় টেক আর কর্পোরেট জগতে। সদ্য প্রয়াত দেশ রূপান্তর সম্পাদক অমিত হাবীব। তার সব সহকর্মীর কাছে তিনি ছিলেন গুরু, ছিলেন বার্তা কক্ষের নেতা।
জন কুইন্সি অ্যাডামস বলেছিলেন, ‘If your actions inspire others to dream more, learn more, do more and become more, you are a leader.’ অমিতের সব অনুসারী তার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখেন বলেই মনে করি।
বিজ্ঞাপন
বার্তা কক্ষের দক্ষ এই নেতার সাথে আমার বন্ধুত্ব বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেই ১৯৮৬-৮৭ সালে। টিএসসিতে ঘণ্টার ঘণ্টা বিপ্লবের কথা বলেছি, আন্দোলন, প্রেম, দ্রোহ আর সংস্কৃতি নিয়ে কত কথা হয়েছে, কিন্তু কখনো সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে নামেনি।
আরও পড়ুন : প্রত্যাশা বেশি বলেই সমালোচনা বেশি
এক সাথে কাজ করা হয়নি। ক্যাম্পাস জীবন থেকেই আমি ইংরেজি দৈনিকে কাজ করি। অমিত হাবিব কাজ করেছেন বাংলা দৈনিকে। বিশেষ করে ভোরের কাগজে তার সময়টায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন আজকের অনেক বড় বড় সাংবাদিকের শিক্ষক।
“মানুষটা ম'রে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি কেউ দ্যায়—বিনি দামে—তবে কার লাভ— / এই নিয়ে চারজনে ক’রে গেল ভীষণ সালিশী।” অমিতের মৃত্যুর পর জীবনানন্দের এই কথাগুলো মনে পড়ছে।
মনে হয়, এই যে সমবেত শোক পালন তাতে কী লাভ? তবে এটাও ঠিক যে, সবকিছু লাভ লোকসানে মাপা যায় না। অমিত হাবিবের মৃত্যু তার জীবনের দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে বাধ্য করেছে।
আরও পড়ুন : আরও কৌশলী হতে হবে সাংবাদিককে
এমন এক নিঠুর সময়ে সহকর্মী ছাড়াও গণমাধ্যম ও এর বাইরের মানুষ তার জন্য শোক অনুভব করছেন এটাই বা কম কীসে? কিন্তু এই যে বলছি, আমরা তার জীবনের দিকে তাকাতে বাধ্য হচ্ছি সেখানেই আমরা আমাদেরও দেখতে চাই সেই আলোকে।
বার্তা কক্ষের দক্ষ এই নেতার সাথে আমার বন্ধুত্ব বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেই ১৯৮৬-৮৭ সালে। টিএসসিতে ঘণ্টার ঘণ্টা বিপ্লবের কথা বলেছি, আন্দোলন, প্রেম, দ্রোহ আর সংস্কৃতি নিয়ে কত কথা হয়েছে, কিন্তু কখনো সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে নামেনি।
আজকাল যে তারকা সাংবাদিকের সরব উপস্থিতি এই ভুবনে, সেখান থেকে দূরে ছিলেন অমিত। তিনি প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে থেকে নিভৃতে কাজ করতে ভালোবাসতেন।
অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন যেমন ভোরের কাগজ, যায় যায় দিন, কালের কণ্ঠ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অমিত হাবিবের নেতৃত্বের কথা আলোচিত হয়।
আরও পড়ুন : মিশুক স্যার : ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতার স্টাইলশিট
অমিত হাবিব সাংবাদিকতায় ডিগ্রি নিয়ে এই পেশায় আসেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রায়োগিক সাংবাদিকতার শিক্ষক। এক সময় আমি পত্রিকা ছেড়ে সম্প্রচার মাধ্যমে চলে আসি। অমিত হাবিব বলেছিলেন, ইংরেজি সাংবাদিকতায় আপনার আরও কিছুদিন থাকা দরকার ছিল।
আমাদের যোগাযোগ সবসময় ছিল। নতুন কোনো উদ্যোগ—সেটা তার রেস্তোরাঁ বাণিজ্য হোক কিংবা নতুন পত্রিকায় আলাপ শুরু হোক, তার চেষ্টা ছিল আমাকে জানানো।
আমি নিজেও প্রতিষ্ঠান বদলেছি বারবার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করে। চলার পথে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সেই অভিজ্ঞতা সবচেয়ে ভালো ভাবে আহরণ করা যায়।
তার সবই সুখকর হয়, তেমনটি বলা যাবে না। আমরা সেই কথা আলোচনা করতাম আর নিজেদের বোঝাতাম ভালো-মন্দ কোনোটাই ফেলনা নয়, সবই অর্জন।
আরও পড়ুন : গণমাধ্যম আইন : নিশ্চিত হোক মর্যাদা, অধিকার, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা
দেখা হলে আলোচনার বিষয় থাকত সাংবাদিকতা, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান। আমরা বলতাম, পেশায় আসার আগে মনে হতো লড়াইটা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারছি এই লড়াই আরও বিস্তৃত। গণমাধ্যমের মালিকের সাথে, নিজের সহকর্মীদের সাথে, অ-পেশাদারিত্বের সাথে, ইউনিয়নের সাথে আর নিয়ত বিভাজিত রাজনীতির সাথে।
অমিত হাবিব সাংবাদিকতায় ডিগ্রি নিয়ে এই পেশায় আসেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রায়োগিক সাংবাদিকতার শিক্ষক...
তাই অমিত হাবিব জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য হতে পারেননি কখনো এই রাজনীতি সমৃদ্ধ সাংবাদিক নেতাদের পকেটে না ঢোকার জন্য। অবশ্য এটা নিয়ে তার ভেতর কোনো আফসোসও দেখিনি কখনো।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ক্ষেত্রেই মানের বদল ঘটে। সাংবাদিকতায়ও ঘটেছে। কেউ তাকে ভালো বলতে পারেন, কেউ খারাপ। কিন্তু সময়ের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুণগত পরিবর্তনকে স্বীকার করে কীভাবে এগোতে হয় সেটা বড় বিষয়। এ এক নিরন্তর প্রক্রিয়া।
আরও পড়ুন : অন্তত ‘লঘুদণ্ড’টা যেন টেকে
আজ যা নতুন, কাল তা পুরোনো। অমিত হাবিব প্রতিনিয়ত নতুনের সন্ধান করেছেন। আগে সব ভালো ছিল, এখন আর নয়—এই নীতি মানতেন না তিনি। বলতেন ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং পেশাগত গণ্ডিতে পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতেই হবে। অতীত আঁকড়ে থাকার কিছু নেই।
দুঃখ ছিল অনেক। আর সেটা হলো, যেটা করতে চাওয়া সেটা করতে না পারা। সংবাদপত্রের আসল স্থান হলো তার আদর্শগত অবস্থান। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগৎ প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠতে না পারায় মানুষের স্বার্থে শাসকের দিকে আঙুল তোলার সাহস দেখাতে পারে কম।
সেখানে রাজনীতির রং-ই যে বড় বিবেচ্য সেটা আমাদের আলোচনায় আসত। ধর্মীয় ও সামাজিক বিভাজনের সাম্প্রতিক আবহে, দস্যুদের মালিকানায় সাংবাদিকতা কতটা কঠিন সেই আলোচনাও হতো।
এখন আর হবে না। অমিত হাবিব অনেক দূরের বাসী এখন। ৫৯ বছর যে কারও চলে যাওয়ার জন্যই কোনো বয়স নয়। কিন্তু তাকে যেতে হয়েছে।
হয়তো পেশার কারণে অনিয়ম সঙ্গী ছিল তার। বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ লেখা বড় কঠিন, সেটাই লিখতে হলো নিয়ম করে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন