টেকনাফ ইউএনও’র অশালীন আচরণ
অন্তত ‘লঘুদণ্ড’টা যেন টেকে
সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন পছন্দ না হওয়ায় ঢাকা পোস্টের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি সাইদুল ফরহাদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার ঘটনায় টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কায়সার খসরু’র বিরুদ্ধে দ্রুতই নানা ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে।
ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পরপরই ডিসি মো. মামুনুর রশীদ ওই ইউএনও এবং সাংবাদিকদের নিয়ে একসাথে বসেন, সেখানে ইউএনও তার আচরণের জন্য ক্ষমা চান, শোকজ করাসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে ডিসি জানান।
বিজ্ঞাপন
২৫ জুলাই ২০২২, মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ওই ইউএনওকে ওএসডি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন : মন্ত্রী নাকি আমলা?
মন্ত্রিপরিষদ সচিব সেই সময় আরও কিছু কথা বলেন যার একটি লাইন বাদে বাকিটা ভালো লেগেছে। ইউএনও যে ভাষা ব্যবহার করেছিলেন সেই প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘কারো সঙ্গে আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনি যত উপরের দিকে থাকবেন তত মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলতে হবে। আমি যদি কাউকে বলি আপনি একজন অসভ্য লোক, দ্যাট ইজ এনাফ। একটা লোককে যদি আমি খারাপ বলতে চাই, এই লেভেলে দিস ওয়ার্ড ইজ এনাফ। এরপরে কি আজেবাজে কথা বলার দরকার আছে? ওই ল্যাঙ্গুয়েজ কেন ইউজ করতে হবে? গতকাল কমিশনার কনফারেন্সে আমরা বিষয়টা খুব স্ট্রংলি বলে দিয়েছি, কমিশনাররা যে যে জেলাতে যাবেন, সব অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে বসবেন। যেহেতু বিষয়টি কোর্টে গেছে, আমাদের প্রতি নির্দেশনা আছে তাকে ওএসডি করে তার বিরুদ্ধে আদালত কী ইন্সট্রাকশন দেন সে অনুযায়ী অ্যাকশন নেওয়ার জন্য। তবে প্রায় ৫০০টি উপজেলার ৫০০ জন লোকের মধ্যে সবাই ভালো হবে, এতটা আশা করা ঠিক নয়।’ (ঢাকা পোস্ট, ২৫ জুলাই ২০২২)
ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্র এমন একটি যন্ত্র যার ভেতরে ঢুকলে তা প্রতি মুহূর্তে শেখায় তুমি শাসক, আর দশজনের চেয়ে আলাদা এবং তোমার অবস্থান অনেক উপরে।
এই শেষ লাইন কিছুটা দুঃশ্চিন্তার। এর মানে ৫০০ ইউএনও’র মধ্যে কেউ কেউ এই রকম আচরণ করলে তা অস্বাভাবিক নয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিশ্চয়ই এটা বোঝাতে চাননি কিন্তু এই মন্তব্যের মাধ্যমে কেউ কেউ এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে এমন আচরণে উৎসাহী হতে পারে। অবশ্য এই রকম উৎসাহমূলক বড় একটি উদাহরণ ২০২১ সালের নভেম্বরেই তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন : দুর্নীতি থাকলে দেশ এগোবে না
বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগান শহরের একটি সরকারি পুকুর সংস্কারের পর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন সেটি নিজের নামানুসারে ‘সুলতানা সরোবর’ রাখতে চেয়েছিলেন জানিয়ে বাংলা ট্রিবিউনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন।
এর কয়েকমাস পর ডিসি’র নির্দেশে গভীর রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে রিগানকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মাদক রাখার কথিত অভিযোগে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে ডিসি’কে ওএসডি করে ঘটনার তদন্ত হয়।
সরকারি সেই তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সুলতানা পারভীনের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখার শাস্তি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই সংক্রান্ত সার্কুলারেই বলা ছিল এটা ‘লঘুদণ্ড’। কিন্তু এই লঘুদণ্ডও মানতে পারেনি আমলাতন্ত্র।
আরও পড়ুন : সমাজে নৈতিক অবক্ষয়
সুলতানা পারভীন এই শাস্তি মাফ করার জন্য কাছে আবেদন করেন এবং রাষ্ট্রপতি তা বিবেচনা করে দণ্ড বাতিল করে তাকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি দেন। তবে এজন্য রাষ্ট্রপতির ওপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই।
সংবিধানে বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্যসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করবেন। এ থেকে বোঝা যায়, নিজের মন্ত্রণালয়ের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করার সিদ্ধান্ত সুলতানা পারভীনের ব্যক্তিগত নয়,আমলাতন্ত্র তাকে মদদ দিয়েছে এবং শাস্তি মাফ করার ব্যবস্থা করেছে। উপ-সচিব সুলতানা পারভীন ২০২২ সালের জুন মাসে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হয়েছেন।
এমন উদাহরণ সামনে থাকলে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব যত ভালো ভালো কথাই বলুন, প্রশাসনের তরফ থেকে সাংবাদিক নিপীড়ন বন্ধ হওয়ার কথা নয়। কারণ, আমরা জানি কথা নয়, কাজই গুরুত্বপূর্ণ।
পেশাগত কারণে বহুবার সচিবালয়সহ বহু সরকারি অফিসে যেতে হয়েছে। সাংবাদিকতা জীবনের শুরুর দিকে দেখেছি সাধারণ মানুষ তো বটেই, ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’ বলে স্বীকৃত বা অভিযুক্ত সাংবাদিকদের জন্যও সরকারি কর্মকর্তাদের দেখা পাওয়া কঠিন ছিল।
প্রশাসনের কর্মকর্তা আর সমাজের বাকিদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে বলে মনে হতো। কালক্রমে এই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বটে কিন্তু ‘সাইড এফেক্ট’ হিসেবে দেখা দিয়েছে গালিগালাজ, হয়রানি।
আচরণ বিষয় নিয়ে ট্রেনিং ক্লাসের বক্তৃতা কোনো কাজে আসে না কারণ সিস্টেম তাকে শাসক বানায়। সিস্টেমও তো রাতারাতি বদলানো যাবে না। তাহলে কী করণীয়?
টিভিতে আরেকটা প্রতিবেদন চোখে পড়ল। চুয়াডাঙ্গার একটি ঘটনার খবর প্রচারিত হচ্ছিল। পেঁয়াজের বীজ বিতরণের তথ্য নিতে গেলে দামুরহুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান সাংবাদিক শামীম রেজাকে অফিস কক্ষে আটকে রেখে লাঞ্ছিত করেছেন। রেজা থানায় জিডি করেছেন। (২৫ জুলাই ২০২২)
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক দোকান
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের মধ্যে যারা সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের চাকরিতে ঢুকেছিল তাদের কেউ কেউ এখন সিনিয়র সচিব, কেউ কেউ অবসরেও গেছে।
চেয়ারে থাকলে মন খুলে কথা বলে না কেউ, যত বন্ধুত্বই থাক। তাই অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে সম্প্রতি অবসরে গেছে-এমন একজনের সঙ্গে আলাপ করছিলাম।
জানতে চেয়েছিলাম প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এমন আচরণের কারণ কি? সে বলল, ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্র এমন একটি যন্ত্র যার ভেতরে ঢুকলে তা প্রতি মুহূর্তে শেখায় তুমি শাসক, আর দশজনের চেয়ে আলাদা এবং তোমার অবস্থান অনেক উপরে।
বহুকাল ধরে চলে আসা পদ্ধতির রোজকার এই শিক্ষা তাদের মানুষ বা জনগণের সেবকের পরিবর্তে অফিসার বানায়। তাই মনোভাব, আচরণও সেই রকম হয়। কিন্তু সবাই এক রকম নয়-মানবিক, সত্যিই জনসেবা করেন-এমন অনেকেও আছেন।
আমার বন্ধু জানায়-চাকরি শুরুর আগে যারা পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে মূলত তারাই এই পার্থক্য গড়েছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আচরণগত সমস্যাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাচ্ছে না। বরং অন্য আরেক দিক থেকে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
রাজনীতিবিদরা অভিযোগ করছেন, আমলারা রাজনীতিবিদের উপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেছেন। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন এমপিদের অনেকে। এটা সত্যি যে, কয়েক বছরে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতায়ন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশিই হয়েছে।
আরও পড়ুন : দুদক, দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ
এই যে একটি শ্রেণির সঙ্গে অন্যদের দূরত্ব বাড়ছে তা তো সবারই ক্ষতি, কারণ আমলারা এই সমাজেরই কারো সন্তান, কারো ভাই-বোন, আত্মীয়। সামাজিক ভারসাম্যতার জন্য আমরা যখন আগের মতো সেই একান্নবর্তী পরিবারের তাগিদ অনুভব করছি তখন আমলাদের দূরে থাকা বা তাদের দুরে রাখা-কোনোটাই কাম্য নয়।
গুটিকয়েক কর্মকর্তার আচরণগত সমস্যার দায় পুরো আমলাতন্ত্রের নয়। কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাকে শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে আমলাতন্ত্র এই দায় নিজের ঘাড়ে নিয়েছে, আর তার ধারাবাহিকতায় কয়েক ধাপ নিচের কর্মকর্তা টেকনাফের ইউএনও অনেকটা একই রকম আচরণ করতে সাহস পেয়েছেন।
আমার সেই বন্ধু’র ভাষ্যমতে—আচরণ বিষয় নিয়ে ট্রেনিং ক্লাসের বক্তৃতা কোনো কাজে আসে না কারণ সিস্টেম তাকে শাসক বানায়। সিস্টেমও তো রাতারাতি বদলানো যাবে না। তাহলে কী করণীয়? অপরাধ করলে শাস্তির উদাহরণ তৈরি করা। অন্তত ‘লঘুদণ্ড‘টা যেন টেকে।
রেজোয়ান হক ।। বার্তা প্রধান, মাছরাঙা টিভি