সড়ক নিরাপদ হবে কবে?
বর্তমানে দেশে ঊর্ধ্বমুখী সড়ক দুর্ঘটনা মহামারিতে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়কে ঝরছে অগণিত তাজা প্রাণ। খালি হচ্ছে কত মায়ের বুক। সড়কে আর কত মৃত্যু দেখলে আমরা সচেতন হবো?
সম্প্রতি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কোর্টভবন এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেট ফেটে নবজাতক বেরিয়ে আসার একটি মর্মান্তিক ঘটনা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এই ঘটনায় একদিনের ওই শিশুটি হারিয়েছে তার মা, বাবা আর ছয় বছর বয়সী বোনকে। এছাড়াও এবছর রমজানের ঈদে ও কোরবানির ঈদে সড়কে অভাবনীয় প্রাণ ঝরতে দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি। যানবাহনে যতদিন গতি নিয়ন্ত্রণ না আসবে ততদিন সড়কে এভাবে প্রাণ ঝরতে দেখা যাবে। সড়ক-মহাসড়কগুলোতে বেপরোয়াভাবে দ্রুতগতিতে যানবাহন চালানোই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।
আরও পড়ুন : মোটরসাইকেল কীভাবে দূরপাল্লার পরিবহন হয়
সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আইনের যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সরকারের কর্তব্য আইনের মাধ্যমে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা। গতি নিয়ন্ত্রিত হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে লাঘব হবে বলে আশা করা যায়।
আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, প্রায় প্রত্যেক বাসচালক যেন রাস্তায় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কেউ কাউকে বিন্দু মাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। মহাসড়কে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার শতকরা ৮০ ভাগ ঘটে চালকদের বেপরোয়া ও খামখেয়ালি গাড়ি চালানোর কারণে।
আমরা দেখতে পাই একটা গাড়ি আরেকটা গাড়িকে ওভারটেক না করা পর্যন্ত যেন স্বস্তি পায় না। আমাদের দেশের চালকদের এটা একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যতদিন এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সড়কে দুর্ঘটনা কমবে না।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে এবং এতে যেভাবে তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, তা নিয়ে সচেতন মহলের মধ্যে ক্রমেই ক্ষোভ এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এই দুর্ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন : গণপরিবহন কি জনভোগান্তির অপর নাম?
বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে কার্যকর করা হয়েছে বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার এই আইন প্রণয়ন করে।
‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’-এর ধারা ৪৪-এ মোটরযানের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ সড়ক বা মহাসড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সাথে পরামর্শক্রমে বিভিন্ন শ্রেণির সড়কে মোটরযানের গতিসীমা নির্ধারণ বা পুনঃনির্ধারণ করতে পারবে।
কোনো মোটরযানের চালক সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত গতিসীমার অতিরিক্ত গতিতে বা বেপরোয়াভাবে মোটরযান চালাতে পারবে না। কোনো মোটরযান চালক সড়ক বা মহাসড়কে বিপদজনকভাবে বা অননুমোদিতভাবে ওভারটেকিং করতে পারবে না বা মোটরযান চলাচলে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবেন না।
আইনের ধারা ৪৪-এর কিছুটা সংশোধনী পারে এই বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে। যেমন ধারা ৪৪ সংশোধন করে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত গতিসীমার বাইরে মোটরযান চালনা বা অন্য কাউকে চলার অনুমতি প্রদান করবে না। যেকোনো আইন স্পষ্টভাবে প্রধান সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুন : চকরিয়ায় পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু : বিচার ও দায় স্বীকারের সংস্কৃতি
শহরের রাস্তায় গতিসীমা সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। মহাসড়কে গণপরিবহন, হালকা মোটরযান এবং মোটরসাইকেলের জন্য গতিসীমা হবে সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। মহাসড়কে ট্রাক এবং পণ্য পরিবহনের গাড়ির জন্য গতিসীমা হবে সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়।
অধিক জনবহুল এলাকা বা যেখানে বেশি সংখ্যক পথচারী চলাচল করে এমন এলাকায় সবধরনের মোটরযানের জন্য গতিসীমা হবে সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে যে, বিশ্বে সড়কে প্রতি বছর প্রায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় এবং ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন এর মধ্যে প্রাণঘাতী জখম থাকে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর রাস্তায় গতির কারণে প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয়। বড় বড় এবং পথচারী বহুল এলাকাগুলোতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
৮০ টির বেশি বড় বড় শহরে পরিচালিত সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন : যত দুর্ভোগ, তত ক্ষমতা!
গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেলে ৪-৫% দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যানবাহনের গতি যত বেশি কম হবে, পথচারীদের জন্য আহত ও মৃত্যুর ঝুঁকি তত বেশি কম হবে। ৩০ কিলোমিটার ঘণ্টা বেগে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ। ৫০ কিলোমিটার ঘণ্টা বেগে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ।
২০২২ সালের রমজানের ঈদে সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে এবার কোরবানির ঈদে সরকার মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনেন। যার ফলে এই ঈদে সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার তুলনামূলক অর্ধেকেরও বেশি নেমে এসেছে।
তবে সড়কে অনিয়ন্ত্রিত গতির কারণে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাসসহ অন্যান্য যানবাহনের দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অনেকেরই মৃত্যু হচ্ছে। যদি সড়কে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সকল যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে সড়কে দুর্ঘটনা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
তরিকুল ইসলাম ।। অ্যাডভোকেসি অফিসার, কমিউনিকেশন, রোড সেফটি প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন