শিক্ষকের গলায় জুতার মালা কেন?
এক.
শিক্ষক পরিবারের সন্তান আমি। পরিবারের অনেকে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত আছে। একসময় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছিলাম। সম্প্রতি নড়াইলের এক কলেজ অধ্যক্ষকে পুলিশের সামনে গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় লজ্জায় আর অপমানে যখন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি, তখনই জানা গেল সাভারের আরেক শিক্ষককে পিটিয়ে মেরেছে তারই ছাত্র।
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে এক সংসদ সদস্যের সামনে কান ধরে উঠ-বস করানো হয়। সেই ঘটনায় সংসদ সদস্যের তেমন কোনো বিচার হয়নি।
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নওগাঁয় হিজাব বিতর্ক নিয়ে আমোদিনী পালকে নানাভাবে হেনস্থা করা হলো। এভাবে একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে, কিন্তু জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সেই ঘটনাগুলোর পরও সমাজের সচেতন মানুষ প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিবাদে কি মানুষ সত্যি প্রভাবিত হয়েছিল?
দুই.
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেল পুলিশসহ দু-পাশে শত শত মানুষ, তার মধ্য দিয়ে গলায় জুতার মালা, উত্তোলিত করজোড়ে এক ব্যক্তি ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছেন। এই দৃশ্য অমানবিক। অসহ্য। এই দৃশ্য মানুষের জন্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য চরম অপমানের। জাতির জন্য চরম গ্লানির।
ভুক্তভোগীর বয়ান ও ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখার পর প্রশ্ন—পুলিশের সামনে কী করে একজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো হলো? শিক্ষকের গলায় জুতা পরানো আর জাতির গলায় জুতা পরানোর মধ্যে তফাৎটা কই?
তিন.
আরেকজন শিক্ষক—যিনি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের খুব পরিচিত মুখ, তিনি স্ট্যাম্পের আঘাতে খুন হননি, তাকে জুতার মালাও পরানো হয়নি ঠিকই, তবে ধর্মান্ধরা তার সঙ্গে যা করেছে, বাকি জীবনের হিসেবে বুঝিয়ে দিয়েছে।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া অধ্যাপক, গবেষক ও নাট্যকার ড. রতন সিদ্দিকীর বাসায় হামলা হয়েছে। তার পরিবার বলেছে, একটি চক্র বাসার গেটের সামনে নিয়মিত বাজার বসায়, গেটের সামনে সব্জির ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে। এসবের প্রতিবাদ করায় এই হামলা।
তবে হামলার ধরনে আসা যাক, গেটের সামনে একটি মোটরসাইকেল রাখা ছিল। রতন সিদ্দিকী বাসায় ঢুকতে পারছিলেন না গাড়ি নিয়ে। মোটরসাইকেলটি তাই তিনি সরাতে বলেন। তারা বলেন, সরাবেন না। এরপর হঠাৎ করেই ‘নাস্তিক’, ‘নাস্তিক’ বলে চিৎকার করে বাসার গেটে হামলা শুরু করে। এই সময় অনেকেই ‘হিন্দু’, ‘হিন্দু’ বলে চিৎকার করেন। এদের মধ্যে কেউ ঢিল ছোড়েন, তারপর গেট ভাঙার চেষ্টা করেন।
রতন সিদ্দিকীকে ঘুষি দেয়, ধাক্কা দেয়, ‘নাস্তিক’, ‘মালাউন’, ‘হিন্দু’ বলে অকথ্য ভাষায় গালি দেয়, তার স্ত্রীকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়, ড্রাইভার এবং দারোয়ানের ওপর হামলা করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘নারায়ে তাকবির’ বলে স্লোগান দিতে থাকে।
চার.
ঘটনাগুলো ধরন প্রায়ই একই—‘হিন্দু’,‘নাস্তিক’ আর ‘মালাউন’ বলে হামলা। আসলে দিনের পর দিন যে সাম্প্রদায়িকতার দানব আমরা তৈরি করেছি, তাতে ‘হিন্দু’ বলে ওপর হামলা হলে, ‘নাস্তিকতা’র ধোঁয়া তুলে হামলা হলে সেটাকে তো ‘অপরাধ’ বলে গণ্য করা হয় না!
উল্টো অন্যদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে। যারা প্রতিবাদ করবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। এর ফলাফল কিন্তু সুদূরপ্রসারী। বহু বছর ধরে এভাবে চলায় এই দেশে একদল লোক এখন এতটাই শক্তিশালী যে তারা হুজুগ তুলে যখন যা ইচ্ছে করে। বিষয়টি সহজভাবে দেখা কিংবা ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসেবে পাস কাটিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।
বলা যেতে পারে, এটি পুরো জাতির বিবেকের টুঁটি চেপে ধরার মতো একটি ঘটনা। এটি যে শুধু ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যার ঘটনা; তা নয়। খুবই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে প্রকাশ্যে সবার সামনে ঘটানো একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য শিক্ষকতা পেশা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটুকু বলা যথেষ্ট হচ্ছে না, বলতে হয় এদেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বাস করাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে যেকোনো অজুহাতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, তাকে দোষী সাব্যস্ত করা কোনো কঠিন কাজ নয়। আর বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিষয়টি আরও সহজ করে দিয়েছে।
ফেসবুকে ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে দিতে পারলেই হবে, পঙ্গপালের মতো শত শত ধর্মান্ধ উন্মাদ কী লিখেছে, কবে লিখেছে, কে লিখেছে তার খোঁজ না নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
পাঁচ.
কয়েক দিনের ব্যবধানে শিক্ষক লাঞ্ছনা এবং শিক্ষক হত্যার ঘটনার পর সচেতন নাগরিকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু এই প্রতিবাদ তো করছেন অল্পসংখ্যক সচেতন নাগরিক।
শিক্ষকদের হেনস্তা এবং হত্যা করা যে সমাজের মাথা হেট হয়ে যাওয়াই নির্দেশ করে; তৈরি করে সমাজের জন্য তীব্র এক গ্লানি। অনুধাবনের বোধ এবং সচেতনতা কি বর্তমান সমাজে বহু মানুষের মধ্যে আছে? এখানে শিক্ষকদের অপমান আর নিগ্রহের ঘটনা তো নতুন নয়।
শিক্ষকদের মর্যাদা এই সমাজে অনেক মানুষ অনুধাবন করতে পারছে না। এমন অশুভ আর বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখে রাষ্ট্র কি উদ্বিগ্ন? মানুষকে আলোকিত করার কাজে যারা যুক্ত, তাদের অপমান, আঘাত করা যখন সহজ হয়ে যায়; তাদের অমর্যাদা করা হয়ে পড়ে অতি সাধারণ ব্যাপার, তখন স্পষ্ট—জ্ঞানের আলো আর মননশীলতা সেই সমাজে আর প্রয়োজন নয়। প্রাধান্য পাচ্ছে ক্ষমতার কদর্য দাপট দেখানোর রুচিহীন প্রবণতা, সাম্প্রদায়িকতার নতুন নতুন চোখ রাঙানো।
জ্ঞানচর্চা যদি সমাজে মূল্যহীন হয়; এই সমাজে মানুষের মনের অন্ধকার আর লজ্জাহীনতাই স্পষ্ট করে। বিবেচনাবোধ শূন্য মানুষ লজ্জা অনুভব করে না। তাই তারা কুৎসিত আচরণ করতে পারে অবলীলায়। মনের উন্নয়ন ঘটানোর জন্য আন্তরিক উদ্যোগ এখনই না নিলে যে বিপদ আর অন্ধকার সমাজে গাঢ় হচ্ছে, তা দূর করা হয়ে পড়বে আরও কঠিন।
ছয়.
রাষ্ট্র ইচ্ছে করে নাগরিকদের নিরাপত্তা দিচ্ছে না। এই যে বিভাজনের রাজনৈতিক সুবিধা, রাষ্ট্রের ভূমিকার না পালন করার বিষয়ে সেগুলো নিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন তুলছি না।
সরকারের তো একটা দায়িত্ব ছিল, ভিন্নমত সহ্য করার জন্য একটা সরকারের বা রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে সেটা রক্ষা করা। সেক্ষেত্রে সরকার কোথায়, সেই প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে উঠে আসছে।
গোটা দেশজুড়ে যা হচ্ছে, সহিষ্ণুতার পরিবেশ ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে। আজকের পরিস্থিতি কেবল ধর্মের নামে আঘাত করা নিয়ে তৈরি হয়নি। রাজনীতিসহ অন্য অনেক কিছু নিয়েই ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা তৈরি হচ্ছে।
রাষ্ট্রকে সজ্ঞানে ভাবনা-চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে-আমরা দেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তুলব কি না। শুধু বক্তব্য আর বক্তৃতায় বড় বড় কথা বলে এটি হবে না।
জনগণ সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকছে বলে সরকারও জনপ্রিয়তার সুবিধা নিতে চাচ্ছে, নাকি সরকার নিজেদের সুবিধার জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছে? ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যতগুলো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, তারা প্রত্যেকেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। আপাতত পর্যবেক্ষণ তাই বলে। এই পপুলার ভোট দিয়েই তারা বৈতরণী পার হতে চায়।
একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আমরা সাম্প্রদায়িকতার এই দুরারোগ্য ক্যান্সার কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, সেটি দেখতে পাই। এই দেশের ভিন্ন ধর্মের শিশুরা তাদের সমবয়সী অন্য শিশুদের কাছ থেকে কীভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। কীভাবে কীভাবে জানি এই দেশের শিশুদের বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের সব ধর্মের জন্য শ্রদ্ধাবোধ শেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
পরিবার কিংবা সমাজ থেকে যদি আমরা সব ধর্মের জন্য সম্মানবোধ শিখাতে না পারি, তখন সেটি শেখানোর শেষ জায়গা হিসেবে তাদের স্কুল কিংবা পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। অতীতে হেফাজতের হুমকিতে যেভাবে পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন করা হয়েছিল; যদি সেই লজ্জাজনক অবস্থান থেকে আমরা বের হতে না পারি তাহলে কোথায় যাব জানি না!
মনে হচ্ছে সরকার বোধ হয় সবক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ দেখাতে পারছে না। বরঞ্চ যখন যে অংশটা ফুঁসে উঠছে, তাদের খুশি করার জন্য তড়িঘড়ি করে কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এবং এক ফুটো সারাতে গিয়ে আরেক ফুটো তৈরি হচ্ছে, সেই ছিদ্রটা আরও বড় হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, সেই জায়গাটা বোধহয় তারা আর ব্যালেন্স করতে পারছে না।
সাত.
প্রথম থেকে গোড়ায় ‘গলদ’ রয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত অর্থে শিক্ষা ও শিক্ষককে টেনে নামানো হয়েছে ময়লার খাদে। শিক্ষকের কোমরে দড়ি বেঁধে, মুখে স্কচ টেপ দিয়ে বলা হয়েছে—এবার চড়ে ফিরে খা। আর তাই অব্যর্থভাবে শিক্ষকের গলায় উঠেছে জুতার মালা, ‘কল্পিত’ রোষ গিয়ে পড়েছে সমাজের এই নিরীহ প্রাণীর ওপর।
শিক্ষকের মর্যাদা আসলে কোথায়? এটাই সত্য, শিক্ষক মর্যাদার অভাব যখন প্রতিটি স্তরে অগ্রসর হচ্ছে, শিক্ষা এবং শিক্ষককে সংকুচিত হচ্ছে, কিংবা ‘সৃজনশীলতা’র নামে অতিমাত্রায় পাঠ্যপুস্তকে হাজার বছরের সংস্কৃতিকে উগড়ে ফেলার মতো ঘটনাগুলো হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সিলসিলা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তখন এই ধরনের লাঞ্ছনা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
দায় তো রাষ্ট্রকেই নিতে হবে, অনন্তকাল অসাম্প্রদায়িকতার ক্ষত বয়ে যেতে হবে তাকে। কয়েক বছরে শিক্ষার ওপর যে পরিমাণ ‘এক্সপেরিমেন্ট’ আমরা চালাচ্ছি, তার শেষটা হচ্ছে অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন আর সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনা। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তো তাই বলে।
প্রতি মুহূর্তে আমরা আমাদের শিক্ষার্থী কিংবা পারিপার্শ্বিকতা আলোর বদলে অন্ধকারের সামনে দাঁড় করিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষাকে বানিয়েছি বাণিজ্যের ‘পসরা’, আর ‘অসুস্থ’ প্রতিযোগিতার অশ্বারোহী। শিক্ষা যদি সঠিকভাবে গড়ে না ওঠে, তাহলে রাজনীতিও কখনো সুশাসনের দিকে এগোবে না। ওটা কেবলমাত্র রাজনীতি থাকবে, পায়ুপথে টর্চলাইট ঢুকানোর মতোই।
অধিকাংশ শিক্ষক বলেন, ক্লাসরুমে কথা বলা মুশকিল; ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি আর ইতিহাসই হোক না কেন! মনে হয়, কেউ ওঁত পেতে আছে, কেউ নজরদারি করছে, কেউ ষড়যন্ত্র করছে।
বাংলাদেশে ধর্ম, বিজ্ঞান ও সাম্প্রদায়িকতা আজ একাকার হয়ে গেছে। শিক্ষা ও শিক্ষককে যদি বিভক্তি, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার খড়গের নিচে দাঁড় করানো হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতভাবেই ডুবে যাবে গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে। সেক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ বা সুশাসনের কী-বা এসে যায়!
হাবীব ইমন ।। সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি