ছবি : সংগৃহীত

গল্পটা তৎকালীন এবং বর্তমান বিভাগীয় শহর রাজশাহীর। ওই বিভাগে ‘ঘোড়ামারা ড্রামাটিক ক্লাব’-এর মহড়া চলছে নাট্যাভিনেতা, নাট্য পরিচালক সর্বোপরি রাজশাহীর নাট্যগুরু মোহাম্মদ তফাজ্জল হোসেন মল্লিকের বাড়ির বারান্দায়। তাকে সকলেই মাস্টার বলে সম্বোধন করতেন।

তিনি থিয়েটার তথা অভিনয়কে এমনই এক সুউচ্চ স্থানে অবস্থান দিয়েছিলেন যে পরিবার এবং থিয়েটারের মাঝে কোনো বাঁধা তৈরি করেননি। ফলে, মহড়া চলাকালীন সময়ে বাড়ির ছেলেমেয়েরাও এসে বসে মনোযোগ দিয়ে দেখতো অতি পরিচিত একেকজন সাধারণ মানুষকে অসাধারণ সব চরিত্র হয়ে ওঠা।

একটি নাটকের মহড়াকালীন সময়ে একজন শিশুশিল্পীর প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন নাট্যগুরু মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মল্লিক। তখন নাটকের দলের একজন সদস্য পরামর্শ দিলেন মহড়ার সময়ে প্রতিদিন বসে থাকা নাট্যগুরুর বড় কন্যা মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সী লিলি’কে নাটকের শিশু শিল্পী হিসাবে যুক্ত করতে।

চরিত্র লিলি পূর্ণাঙ্গরূপ দিতে পারবে কি না তা নিয়ে নাট্যগুরু সংশয় প্রকাশ করলেও লিলি কিছু না ভেবেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উত্তর দিয়েছিল ‘পারবো’। লিলি’র মঞ্চে পদার্পণ হয়েছিল সাড়ে চার বছর বয়সে এবং অভিনয়শিল্পী হিসেবে প্রয়াণ ঘটল ৭৫ বছর বয়সে। লিলি, যার আসল নাম মাজেদা মল্লিক পর্দার নাম শর্মিলী আহমেদ।

পরিবারের স্নেহের বড় কন্যা মাজেদা মল্লিকের নাট্যগুরু স্বয়ং পিতা মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মল্লিক এবং বড়পর্দার পরিচালক রকিবউদ্দিন আহমেদ-এর নামানুসারে হয়ে গেলেন শর্মিলী আহমেদ।

শৈশব থেকে প্রয়াণ পর্যন্ত আমরা দেখি, তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। কাজে মনোযোগী। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন। যা সচারচর একজন মানুষের মধ্যে কমই দেখা যায়। তিনি মঞ্চে জীবন শুরু করলেও অভিনয়ের সকল শাখায় ছিল তার বিচরণ।

শর্মিলী আহমেদ একজন মায়াবতী মানুষ ছিলেন। মায়া করতেন সহকর্মীদের, পরিচালক, সহ-পরিচালক, প্রোডাকশন, ক্যামেরা, লাইট, হাউসের সকলকে।

১৯৬২ সালে তিনি রেডিওতে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে স্বাধীনতা পূর্ববতী সময়ে তিনি উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেন।

১৯৭৬ সালে তিনি প্রথম মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন মোহাম্মদ মহসিন পরিচালিত ‘আগুন’ চলচ্চিত্রে, যখন তার বয়স মাত্র ২৯। অবাক করার মতো বিষয়। যিনি নায়িকার ভূমিকায় একের পর এক চলচ্চিত্র করে চলেছেন, তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় শুরু করলেন!

অন্য অভিনয়শিল্পী হলে কি করতেন বলতে পারি না, কিন্তু তিনি ভালোবেসেই অভিনয় করেছিলেন এবং করতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার সম্পর্কে অভিনয় জগতের মানুষদের সাথে কথা বললেই। তিনি বেশিরভাগেরই অভিনয় করেছেন মা, আন্টি, কাকী অথবা চাচী চরিত্রে।

শর্মিলী আহমেদ একজন মায়াবতী মানুষ ছিলেন। মায়া করতেন সহকর্মীদের, পরিচালক, সহ-পরিচালক, প্রোডাকশন, ক্যামেরা, লাইট, হাউসের সকলকে। তার মায়ার নিদর্শন এমন ছিল, কাজে একজন সহশিল্পী যার বাসা অনেকদূর শুটিং শেষে তিনি ঘরে ফিরবেন আবার সকালে আসবেন, থাকেন একা, তাই ঘরে ফিরে তাকে রান্না করতে হবে, খেতে হবে, তারপর না তিনি ঘুমাতে যাবেন।

এই বিষয় জেনে, আগামী কয়েকদিন তাকে এই কঠিন জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তিনি বাসায় নিয়ে যেতেন, আপ্যায়ন করতেন এবং সকালে তাকে সাথে নিয়েই কর্মক্ষেত্রে আসতেন। পরিচালকেরা ঠিক যে সময়ে কল টাইম দিতেন তিনি সেই সময়েই কর্মস্থলে উপস্থিত হতেন।

ইউনিটের প্রতিটি মানুষ খেয়েছেন কি না, তারা সুস্থ আছেন কি না, পরিবারের সকলে ভালো আছেন কি না—সকল খোঁজ তিনি রাখতেন নিয়মিত। পাণ্ডুলিপিতে রান্নার দৃশ্য থাকলে তিনি কড়াই খুন্তি নিজে ধুয়ে তরকারি কেটে চমৎকার রান্না করে ফেলতেন, সেই খাবার আবার ইউনিটের সকলকে একটু একটু করে ভাগ করে খাওয়াতেন।

প্রায়শই ঘর থেকে বাটি ভরে খাবার নিয়ে আসতেন ইউনিটের সকলকে সাথে নিয়ে খেতেন। নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন মিডিয়া সংশ্লিষ্ট অনেকের, তাদেরকে নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। তিনি তো বয়স, অভিজ্ঞতা এবং অগ্রজ হিসেবে দেরি করতে পারতেন কর্মক্ষেত্রে! কিন্তু তা তিনি করেন না। সর্বপ্রকার সহযোগিতা করে গেছেন কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি মানুষের।

স্নেহপরায়ণ শর্মিলী আহমেদ প্রতিদিন নিয়ম করে ভাইবোনদের খবর নিতেন। ভাইবোনের ছেলেমেয়েরা এবং একমাত্র নাতনি ছিল তার পরম আদরের।

তার স্টাইল দারুণভাবে লক্ষণীয়, এই রকম চুলের সিঁথি, ভীষণ মার্জিত লিপস্টিক, খুব গুছিয়ে মানানসই শাড়ি। যেহেতু পেশা অভিনয়। পা থেকে মাথার বিষয়ে তিনি ছিলেন ভীষণ যত্নশীল। গ্রিনরুম বা মেকাপরুমে এই টিপসগুলো শেয়ার করতেন স্নেহের অভিনয়শিল্পীদের সাথে, যা আমরা বুঝি না। অথচ তিনি খুব সচেতনভাবে একইরকম কাটিয়ে গেলেন জীবন।

খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে ছিলেন ভীষণ সচেতন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু করতেন রুটিন মাফিক এটা ওটা খাওয়া, একদম ঘুমের আগ পর্যন্ত নিয়ম মেনে চলতেন। মূলত একই ধারায়, একই সাজে পরিমিত জীবনযাপন করে যাওয়া কিন্তু, দৃষ্টান্ত ছিলেন বটে। যা আমরা বুঝি না।

স্নেহপরায়ণ শর্মিলী আহমেদ প্রতিদিন নিয়ম করে ভাইবোনদের খবর নিতেন। ভাইবোনের ছেলেমেয়েরা এবং একমাত্র নাতনি ছিল তার পরম আদরের।

সন্তান তনিমা আহমেদও মা অন্তপ্রাণ কন্যা। সংসারের বাজার-রান্না সব বিষয়ে তিনি ছিলেন মনোযোগী। যে সময়ে নারীরা বাজারের জন্য পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল ছিল সেই সময়ে তিনি নিজে বাজারে গিয়ে পছন্দসই বাজার করতেন। তিনি নিজে সীমিত খাওয়াদাওয়া করলেও খাওয়াতে পছন্দ করতেন খুব। তার হাতের রান্না ছিল দারুণ সুস্বাদু।

অভিনয়শিল্পী শর্মিলী আহমেদ প্রায় ৪০০ নাটক ও প্রায় ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের তালিকা সীমাহীন। প্রশংসিত অভিনেত্রী খুব নির্বিকারভাবে কেবল কাজই করে গেছেন। এই মিডিয়া তাকে সম্মান করলেও সম্মানী নিয়ে কিন্তু খুব একটা মাথা ঘামাতেন না।

এই বিষয় নিয়ে কথা বললেই এখন শুনতে হয় ‘শোবিজ বাণিজ্য’র লেকচার। একজন অভিনয়শিল্পী এতটা বছর এই মাধ্যমকে সম্মানজনকভাবে শ্রম দিল, তাকে বা তাদেরকে নিয়েও বাণিজ্যের মনোপলি খেলা চলে। অবশ্যই জনপ্রিয়তার মূল্য আছে কিন্তু অভিজ্ঞতারও যে মূল্য থাকা সমীচীন—বাংলাদেশের শোবিজ জগতে ক্রমশ সেই বিষয়ে বোধশূন্য হয়ে পড়ছে

তাদের কথা ভেবে লেখা হচ্ছে না কোনো পাণ্ডুলিপি। অথচ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে অগ্রজদের নিয়ে নির্মিত একাধিক চলচ্চিত্র দেখতে টিকেট সংগ্রহ করার জন্য দর্শক মাইলের পর মাইল লাইন তৈরি করে। প্রেক্ষাগৃহ হয় পরিপূর্ণ। আমরাও সেই সকল চলচ্চিত্র দেখে আবেগে সামাজিক মাধ্যমে কত শত লাইন লিখি। একবারও ভেবে দেখি না, নিজ দেশের কথা।

রাইসুল ইসলাম আসাদ, আবুল হায়াত, আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, লাকী ইনাম, ফাল্গুনী হামিদ, মাসুম আজিজ প্রমুখ তুখোড় অভিনয়শিল্পীরা কোথায় আছেন? কেমন আছেন? তারা কেন অনিয়মিত শোবিজ জগতে? কেউ কেউ নিয়মিত কাজ করছেন কিন্তু আপস করে।

তাদের কাউকে কাউকে ডাকছেন নির্মাতারা কিন্তু সম্মানীর অসম্মানে অনেকেই কাজ করতে চান না। এখন তারা আছেন তবু সঠিকভাবে মূল্যায়ন পাচ্ছেন না কিন্তু যখন থাকবেন না তখন আবার আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সামাজিক মাধ্যমে কত কী যে লিখব।

শ্রদ্ধেয়া শর্মিলী আহমেদ ষাটের দশকের জনপ্রিয় নায়িকা হওয়া সত্ত্বেও শোবিজ জগতের চাকচিক্য, পুরস্কারের জন্যে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেননি, তিনি ছিলেন সদা হাস্যমুখের মানবিক।

দীক্ষাগুরু পিতার বোধ এবং আদর্শে অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠা তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন, এই পৃথিবীর কোনো কিছুই সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তবু অজেয় হয়ে বেঁচে থাকা যায় মানুষের হৃদয়ে। অহংকার মানুষের সম্মান বিনষ্ট করে।

আন্তরিকতা, আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠা মানুষের আত্মাকে প্রশান্ত করে। তাই তার প্রয়াণে সকলে চোখের জল ফেলেছেন আর বলেছেন, ‘আম্মা.... ও আম্মা... আপনি এভাবে চলে গেলেন...’

নাজনীন হাসান চুমকী ।। অভিনেত্রী, নাট্যকার ও পরিচালক