শ্রীলঙ্কা : কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো?
পর্তুগিজদের পর ডাচদের দখলে এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে একটি একক রাজনৈতিক সত্ত্বা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ব্রিটিশরা ১৯৩১ সালে শ্রীলঙ্কার জনগণের ভোটের অধিকার প্রদান করে এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে আজকের শ্রীলঙ্কা।
বরাবরই তামিল যুদ্ধের জন্য আলোচিত ছিল দেশটি। ১৯৮৩ থেকে তামিল নগরী জাফনাই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। শ্রীলঙ্কা সরকার প্রায় ২ বছর তামিল বিদ্রোহীদের দমনে ব্যস্ত ছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্র হিসেবে শ্রীলঙ্কা একটি বড় সময় অতিবাহিত করছে গৃহযুদ্ধ মোকাবিলায় যা যেকোনো বিচারে আত্মঘাতী ও ধ্বংসাত্মক।
বিজ্ঞাপন
এর মাঝে দেশটি মানব উন্নয়নসূচক থেকে শুরু করে বিভিন্ন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মানদণ্ডে উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান অর্জন করে। কিন্তু সময় কখনো থেমে থাকে না।
কয়েক মাস ধরে দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে এক জটিল ও স্পর্শকাতর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের সামনে এক অচেনা শ্রীলঙ্কাকে দেখা যাচ্ছে।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাজার কিংবা সার্বিক বিচারে অর্থনৈতিক সংকট একটি অবধারিত বাস্তবতা। বিশেষ করে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতির যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে চাপে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
বরাবরই তামিল যুদ্ধের জন্য আলোচিত ছিল দেশটি। ১৯৮৩ থেকে তামিল নগরী জাফনাই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্র হিসেবে শ্রীলঙ্কা একটি বড় সময় অতিবাহিত করছে গৃহযুদ্ধ মোকাবিলায়...
অন্যদিকে উন্নত বিশ্ব তাদের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোকে কয়েক শতাব্দী ধরে বিনির্মাণ করেছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব এই অর্থনীতিগুলো মোকাবিলা করতে অনেক বেশি সক্ষম।
তারপরও উন্নত বিশ্বের জনগণকেও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। কিন্তু শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, উন্নয়নশীল বিশ্বের জনগণ শুধু ভোগ করতে চায়, কষ্ট বা ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়।
আরও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, জনগণের এই অস্বাভাবিক কষ্টকে পুঁজি করে রাজনৈতিক মহল ক্ষমতা দখল করতে মরিয়া হয়ে পড়ছে। ফলে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট একসঙ্গে বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছেছে।
জনগণের একাংশের রাষ্ট্রপতির বাসভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, সচিবালয় ও জাতীয় টেলিভিশন কেন্দ্র দখল ও উল্লাস প্রকাশ, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। প্রত্যক্ষ করছে দেশটির বিবেকসম্পন্ন সাধারণ মানুষ।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য, রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম সবই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য উপকরণ। এই বিষয়গুলো অবজ্ঞা করে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
রাজা যাবে রাজা আসবে, মন্ত্রী যাবে মন্ত্রী আসবে। এই শ্রীলঙ্কাতে অতীতে নির্বাচন হয়েছে, রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়া চালু থাকবে নিশ্চয়। তাহলে আজকে কেন এত অসহিষ্ণুতা, এত বিক্ষোভ?
এই সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা এবং বিক্ষোভ কি কেবল শ্রীলঙ্কার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ? রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন দখল করার মানসিকতার পেছনে অন্য কোনো শক্তি কি কাজ করছে?
এই সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা এবং বিক্ষোভ কি কেবল শ্রীলঙ্কার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ? রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন দখল করার মানসিকতার পেছনে অন্য কোনো শক্তি কি কাজ করছে?
বিশ্বায়ন ও অবাধ-তথ্য প্রবাহের যুগে ভালো-মন্দ সবকিছু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শ্রীলঙ্কা নামক দ্বীপ রাষ্ট্রকে ঘিরে কয়েক বছর ধরে-বিস্তর ভূরাজনৈতিক খেলাও চলছে।
বৃহৎ শক্তিগুলোর আক্রমণাত্মক ও কখনো কখনো নিষ্ঠুর কৌশলের শিকার হয়েছে উন্নয়নশীল দেশসমূহ ও নিপীড়িত সাধারণ জনগণ। উপনিবেশিক যুগ ও স্নায়ু যুদ্ধকাল এর অন্যতম সাক্ষী।
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি কে হবেন? জাতীয় সরকার গঠিত হবে কি না? এই প্রশ্নগুলোর নিশ্চয় সমাধান হবে। কিন্তু এর মধ্যে দেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির ধারক ও বাহক, বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর সীমাহীন নীরবতা প্রদর্শন করছে, ব্যর্থ হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষ করতে।
অথচ এটি কোনো দুরূহ ব্যাপার নয় যদি আমরা বিশ্বে সম্পদ ও প্রাচুর্যের বিশাল ভাণ্ডারের দিকে তাকাই। এই সম্পদ ও প্রাচুর্য বিশ্বে বৈষম্য ও আধিপত্যবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য। শ্রীলঙ্কা সংকট আমাদেরকে সম্ভবত এই শিক্ষাই দিচ্ছে।
ড. দেলোয়ার হোসেন ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ ও পরিচালক, দ্য ইস্ট এশিয়া স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়