বাজেটে নারী ও নারী উদ্যোক্তা
বাজেটে নারীদের উন্নয়নের একটা দিক রয়েছে প্রতিবারের ন্যায়। সেদিক থেকে ইতিবাচক। কিন্তু এই বিষয়গুলো আরও ব্যাপক ও সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত। তাহলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা তথা প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরাও এর সুফল পাবে। নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ও প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টির ধারাবাহিকতা থাকা দরকার।
মহিলাদের অঘোষিত কাজ যেমন গৃহস্থালির কাজের আর্থিক স্বীকৃতি দিতে হবে। ট্রেড লাইসেন্স অ্যাক্ট ২০১৬ সংশোধনী প্রস্তাবনায় ই-ক্যাব থেকে সকল ট্রেড লাইসেন্স ফি’র ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ কম করার প্রস্তাব ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। আশা করি সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে।
বিজ্ঞাপন
এসএমইদের জন্য হস্তশিল্প, পার্লার, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ক্যাটারিং, তৈরি খাবারসহ দেশীয় পণ্য ব্যবসা খাতে মূসক ১৫ শতাংশের জায়গায় ৫ শতাংশ এবং নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে তাদের জন্য তা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি আমরা।
নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা শুরুতে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও এর জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তাছাড়া ঝরে পড়া কমাতে প্রণোদনারও প্রয়োজন রয়েছে। ঋণ ও বিনিয়োগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আরও সহজগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এই ধরনের কিছু বরাদ্দ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পে থাকলেও বাজেটে নির্দেশনা থাকলে তা বাস্তবায়নের বিষয়ে একটা জবাবদিহিতা থাকে।
করোনায় নারী উদ্যোক্তাদের বিরাট অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ নতুন করে শুরু করেছে। আমরা চাই মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত নারী উদ্যোক্তাদের ২০২৫ সালে পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়া হোক। বিশেষ করে অফিস ভাড়ার উপর কর প্রত্যাহার জরুরি।
করোনায় নারী উদ্যোক্তাদের বিরাট অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ নতুন করে শুরু করেছে। আমরা চাই মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত নারী উদ্যোক্তাদের ২০২৫ সালে পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়া হোক।
প্রথমদিকে নারী উদ্যোক্তারা অন্যান্য অনেক প্রতিকূলতার শিকার হয়, এসব বিষয়ে সহযোগিতা দিলে আরও বেশি নারী উদ্যোক্তা উৎসাহিত হবে। এমনকি নারী উদ্যোক্তারা যেন বাসায় বসে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করতে পারে, সেই সুযোগও তাদের দেওয়া উচিত।
মহামারির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটেছে। ফলে বেকারত্ব ও কর্মহীনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আয় কমার পাশাপাশি প্রান্তিক পরিবারগুলোর মধ্যে হ্রাস পেয়েছে ভোগ ব্যয়। তারা বাধ্য হয়েছে ঋণের জালে আটকা পড়তে। তাই নারীদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আয়কর সীমা ৩.৫ লক্ষ টাকার পরিবর্তে ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা দরকার।
বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৭০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি টাকা করা যুক্তিযুক্ত হবে। যেহেতু আমরা নারীর ক্ষমতায়ন চাই। দীর্ঘদিনের বঞ্চনায় নারীরা পিছিয়ে রয়েছে। এখন বিশেষ সুবিধা না দিলে তাদের পক্ষে সমাজের নানা প্রতিকূলতা জয় করে সামনে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া ব্যবসা শুরুর প্রথম ৫ বছর নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কর ছাড় রেয়াত দিলে তাদের জন্য সহায়ক হয়।
নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে ট্রেড লাইসেন্স ফি ৫০ শতাংশের বেশি হ্রাস করা উচিত। নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন, ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বিশেষায়িত ঋণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি মহিলা উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল গঠন, উইমেন চেম্বার এবং সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বৃদ্ধি, পুরস্কার ও বৃত্তির মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং বাজার সংযোগ বাড়াতে সঠিক দিকনির্দেশনা ও কর্মপরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি।
এছাড়া সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য ‘সেফ জোন’ কর্মসূচি চালু ও এর জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দরকার। অসহায় নারীদের ও শিশুদের জন্য ভাতা, কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রশিক্ষণকালীন ভাতা ইত্যাদি সুবিধা দিয়ে আমাদের মেয়েদের জন্য ভরসার জায়গা তৈরি করতে পারি। তাদেরকে আমরা বার্তা দিতে পারি আমরা বা সরকার তাদের পাশে রয়েছে।
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে এফ-কমার্স, ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছে।
ভৌগোলিক অবস্থান, বয়স, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, মিডিয়া এক্সপোজার ইত্যাদির ওপর নারীর ক্ষমতায়ন নির্ভর করে। এগুলোর ওপর নির্ভর করে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, আত্মপ্রত্যয় ও গতিশীলতা। ক্ষমতায়নের সঙ্গে নারীর সুযোগ-সুবিধা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
একজন ক্ষমতাবান নারী নিজের জন্য সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে নিতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, যে নারী নিজের জন্য অধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছে তাকে আমরা ক্ষমতাবান নারী বলতে পারি। এই সুযোগ-সুবিধাগুলো আবার হতে পারে বস্তুগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবিক, তথ্যগত, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি, যা মানুষ তাদের লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োগ করে থাকে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নারীর কর্মসংস্থানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭.২ শতাংশ নারীর মালিকানাধীন, যার বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প।
আমাদের জাতীয় আয়ে এই খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। তাই এই খাতের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা নিজ কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদেরও জীবিকার সুযোগ করে দিচ্ছে এবং জাতীয় আয়ে অবদান রাখছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে এফ-কমার্স, ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছে।
সমাজের আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে তার সক্ষমতা প্রয়োগে হয় সহজতর করে নয়তো বাধা সৃষ্টি করে থাকে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য শুরু থেকেই ছেলে-সন্তানের পাশাপাশি মেয়ে-সন্তানদের ক্ষেত্রে সমান যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। পরিবার থেকেই নারীকে সম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে, যাতে সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে পারে।
এই বিষয়ে অভিভাবকেরা বিশেষ নজর দিলে অবশ্যই একজন নারী সমতার ভিত্তিতে ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাবে। অর্থনীতিতে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে দেশের উন্নয়নে নারীর অবদান বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীবান্ধব নীতিনির্ধারণ ও প্রয়োগ এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করার চেষ্টা করা জরুরি।
নারীর উন্নয়ন ঘটলেই একটি জাতির উন্নয়ন সম্ভব। সব পর্যায়ের নারীর ক্ষমতায়নে সরকার, দেশীয় তথা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভূমিকা রাখবে, এটাই আমার প্রত্যাশা।
নাসিমা আক্তার নিশা ।। প্রেসিডেন্ট, ওমেন অ্যান্ড ই–কমার্স ফোরাম (উই)
nishabd2012@gmail.com