মানুষ সাধারণত অতীত নিয়ে ‘অবসেসড’!
অতীত ও বর্তমানের তুলনামূলক আলোচনায় আমার একটা ভাবনা বা পর্যবেক্ষণ আছে। আর সেটা হলো মানুষ সবসময়ই তার অতীত নিয়ে খুব ‘অবসেসড’ থাকে। আমরা আমাদের ফেলে আসা দিন, ফেলে আসা স্মৃতি, ফেলে আসা মানুষ, জায়গা, সময় নিয়ে খুব স্মৃতিকাতরতায় ভুগি।
এটি এক ধরনের শূন্যতার অনুভূতি দেয়। আর এই শূন্যতা তৈরি করে হাহাকার। এবং এই হাহাকার থেকেই তৈরি হয় অতীতের প্রতি মায়া। আর সেই মায়া অতীতকে অবচেতনেই শ্রেয়তর বা সোনালী হিসেবে আমাদের ভাবনা বা মনোজগতে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে।
বিজ্ঞাপন
একটা উদাহরণ দেই-আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে তখনকার মানুষের কাছে শুনতাম তখন সিনেমা, গান, উপন্যাস ভালো হচ্ছে না। বরং ওই সময়ের আগে অসাধারণ সিনেমা, গান, উপন্যাস হতো। খুব গুণী নির্মাতা, লেখক, গায়ক ছিলেন। কিন্তু তখন আর নেই। তখন যা হচ্ছিল, তা আসলে ছাইপাঁশ। এই আক্ষেপ অহরহ শুনেছি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই ঘটনার কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে এসে এখনো ঠিক একই কথা শুনতে পাই। কেবল সময়কালটা পাল্টেছে। এখনকার জেনারেশন বা কাজ নিয়েও সেই একই আক্ষেপ শুনি যে এখনও কিছুই হচ্ছে না। আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে সবকিছু খুব অসাধারণ ছিল।
খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়টা। কারণ, আজ থেকে সেই কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেও এই একই কথা শুনেছি তার আগের সময়ের সাপেক্ষে। অর্থাৎ তখনও এখনকার মতোই ওই সময়ের আগের সঙ্গে তুলনা করে ওই সময়ের কাজকে এভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। আক্ষেপ করা হয়েছে।
আমার ধারণা, এটা মানুষের সহজাত প্রবণতা। মানুষের কাছে অতীত সবসময় সোনালী, বর্তমান আক্ষেপের আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা বা সম্ভাবনার। আমার বিশ্বাস, এখন শিল্প সাহিত্যের যেসব ধারা নিয়ে আক্ষেপ করা হচ্ছে, আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে এগুলো নিয়েই স্মৃতিকাতর হবে মানুষ।
এখনকার কাজগুলো নিয়েই আফসোস করা হবে। বলা হবে, ইশ, কী অসাধারণ সব কাজই না তখন হতো! কত ভালো ভালো লেখ ছিল পত্রিকায়। ঈদ ম্যাগাজিনে কী অসাধারণ সব আয়োজন ছিল। টেলিভিশনে কী দারুণ প্রোগ্রাম হত। কী গুণীগুণী লেখকরা লিখতেন। আর এখন, কী যে সব হচ্ছে!
সুতরাং, এটা নিয়ে খুব বেশি ভাবিত হওয়ার আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি বরং বিশ্বাস করি, এখনো ভালো বৈচিত্র্যময় ঈদসংখ্যা বের হচ্ছে। দারুণ দারুণ লেখকরা অসাধারণ সব লেখা লিখছেন।
আর যদি সেরকম নাও হয়ে থাকে, তবে তা নিয়ে হয়তো আক্ষেপ বা স্মৃতিচারণ করা যেতে পারে। কিন্তু এটাও ভাবনায় রাখতে হবে যে সময় পাল্টেছে। মানুষের বিনোদনের ধরণ ও উপায় বদলেছে। এখন এই পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে অতীতের তুলনামূলক আলোচনা করতে গেলে খুব সতর্কতার সঙ্গে, বর্তমানের অনেক প্রভাবক ও উপাদনের সংযুক্তি ও প্রভাব বিবেচনা করে তা করতে হবে।
কে জানে, হয়তো এই ঈদসংখ্যার যে সংস্কৃতি সেটাই বদলে যেতে পারে। সেখানে অন্যকোনো উপায়ে এটির নবায়ন কিংবা অভিযোজন ঘটতে পারে। যেমন ঈদ সংখ্যার সংস্কৃতি শুরু হওয়ার আগে হয়তো অন্যকিছু ছিল। সেটা বদলে ঈদসংখ্যার সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। সুতরাং এটাও যে একই আদল বা প্রকৃতিতে অনন্তকাল বহমান থাকবে, সেটা আশা করা বোধকরি ঠিক নয়।
সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ডায়নামিক বা গতিশীল। সংস্কৃতি কন্সট্যান্ট বা স্থির কোনো বিষয় নয়। সুতরাং এই গতিশীলতাই পরিবর্তনকে অনিবার্য করে তুলবে। করবে। এটাই অবশ্যম্ভাবী।
তাহলে এই গতিশীলতায় আমাদের কাজ কী? আমাদের কাজ হচ্ছে আমরা যে কাজটিই করি না কেন, সেটি যেন ভালোবেসে করি, সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করি, সেটি নিশ্চিত করা। এটি হলে সংস্কৃতির অনিবার্য সেই পরিবর্তন হবে ইতিবাচক। আর আমরা হবো সেই ইতিবাচক পরিবর্তনের পথিকৃৎ।
সাদাত হোসাইন ।। কথাসাহিত্যিক