শিক্ষকতা-শুধু একটি পেশার নাম নয় বরং এটি একটি মহান ব্রত। একজন মানুষ এই পেশায় আগমনের মাধ্যমে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেন সমাজে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের উদ্দেশ্যে। একজন শিক্ষক সমাজ থেকে অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার দূর করে সমাজে প্রতিটি ঘরে জ্বালিয়ে দেন জ্ঞানের প্রদীপ।

একটি সমাজ শিক্ষকদের হাত ধরেই সভ্যতার পথে এগিয়ে যায়। নিঃসন্দেহে শিক্ষকেরা হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকেরা স্বমহিমায় বিশুদ্ধ জ্ঞান, মানবিক আর নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং দিক্ষীত করে গড়ে তোলেন দেশের যোগ্য নাগরিক। শিক্ষা যদি আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার হয়, তবে শিক্ষকেরা হলেন তার সুনিপূণ কারিগর।

একথা বলতে দ্বিধা নেই যে আমাদের উপমহাদেশেও শিক্ষকেরা ছিলেন সম্মানের পাত্র। সমাজের ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের কাছে এক জন শিক্ষক ছিলেন পরম পূজনীয় এক ব্যক্তি। মোঘল সম্রাট আলমগীরের শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ঘটনা সর্বজনবিদিত।

গুরুদক্ষিণা প্রথাও আমাদের উপমহাদেশে এক বহুল প্রচলিত প্রথা। শিক্ষককে সম্মানিত করাই ছিল এক সময় আমাদের সমাজের মূল নীতি। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেই জায়গা থেকে সমাজ বহু দূরে সরে গেছে। আমাদের বর্তমান সমাজ এক বীভৎস সমাজে রূপ নিয়েছে। 

এই সমাজে শিক্ষক যেন চরম অবহেলিত এক ব্যক্তির নাম। এই সমাজে শিক্ষক হলে তাকে সব সময় সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অনিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। অথচ একটি সমাজ কতটা সভ্য হবে সেটা শিক্ষকেরাই নির্ধারণ করবেন।

শিক্ষকেরা যত বেশি মানসম্পন্ন হবেন দেশটা তত বেশি সভ্য হবে। কী অদ্ভুত দেশে বসবাস করছি আমরা! সারাক্ষণ সভ্যতার ফেনা তুলি মুখে অথচ সভ্যতার আলোর মশাল যে শিক্ষকদের হাতে তাদের করি পদে পদে লাঞ্ছিত। 

সম্প্রতি সময়ে যখন দেখি এক শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর অপরাধে জেলে যেতে হয় কিংবা আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়ায় ছাত্র স্টাম্প দিয়ে তাকে পিটিয়ে শিক্ষককে মেরে ফেলে অথবা পুলিশ প্রহরায় শিক্ষককে জুতার মালা পড়ানো হয় তখন আসলে সমাজের সেই পচা গলা বীভৎস রূপ আরেকবার চোখের সামনে চলে আসে। 

অবকাঠামোগত উন্নয়নের জিকির করতে করতে আমরা কবে যে আত্মিকভাবে পচে গলে নষ্ট হয়ে গেছি, তা হয়তো আমরা নিজেরাও জানি না। উচ্ছৃঙ্খলতা, সহিংসতা, ঔদ্ধত্য এবং সাম্প্রদায়িকতা আমাদের আত্মিকভাবে তিলে তিলে গ্রাস করছে। আমাদের করে তুলছে বোধ ও বুদ্ধিহীন। 

কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, সেই বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রতা, সহিংসতা ও রুচিহীনতা যদি রপ্তানি করা যেত তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের দেশ পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশের একটি হতো। পরিতাপের বিষয় হলো এই ভয়াবহ বিষয় থেকে পরিত্রাণের বিষয়ে কারও কোনো আগ্রহ নেই। সবাই ছুটছে অর্থ-বৈভব প্রতিপত্তির পেছনে। অথচ এই সমাজ ভুলে গেছে অর্থ-বৈভব কিংবা প্রতিপত্তি ধরে রাখার জন্য নিজেদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা জরুরি, নিজেদের সভ্য করা জরুরি।

যে শিক্ষার্থীর এমন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উন্মুখ হওয়ার কথা, সেই শিক্ষার্থীরা আজ শিক্ষক লাঞ্ছিত করছে। যে শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের জাল বোনার কথা, যে  শিক্ষার্থীদের শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় বিচরণের কথা সেই শিক্ষার্থীদের মগজে হচ্ছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার চাষ। এর দায় আসলে কার? ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র কেউ কি আর দায় এড়াতে পারে? 

শ্রেণিকক্ষকে বলা হয় পৃথিবীর সব চেয়ে বড় মুক্তচিন্তার স্থান। সেই স্থানেও মুক্ত চিন্তাকে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একজন শিক্ষককে জেলে পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। অথচ মহানবী মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো।’ (আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৬১৮৪)। শ্রেণিকক্ষকে অনিরাপদ করার মাধ্যমে আসলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই অনিরাপদ করা হচ্ছে। 

একজন শিক্ষার্থীর মগজে কতটা পচন ধরলে সেই শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে পিটিকে হত্যা করতে পারে? সমাজে পেশি শক্তির আস্ফালন কোন পর্যায়ে গেলে একজন কোমলমতি শিক্ষার্থী সেই পেশি শক্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে বিন্দু মাত্র দ্বিধাবোধ করেন না!

সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি কতটা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পেলে একজন শিক্ষার্থী নির্দ্বিধায় আইন নিজের হাতে তুলে নেয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সময় কি আমাদের আছে?

আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি একটি সমাজে কত গভীর পচন ধরলে একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরতে হয়? সেই শিক্ষক যখন জুতার মালা পরলেন তখন তো কেউ প্রতিবাদ করেইনি বরং সেই কর্তাব্যক্তিরা জুতার মালা পরিধান বিষয়ক কর্মকাণ্ড যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে পারে সেই বিষয়ে সর্বাত্নক মনোনিবেশ করেছেন।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে উপস্থিত সেই সব কর্তাব্যক্তিদের কি শিক্ষকের অপমানের সময় নিজেদের শিক্ষকের কথা মনে পড়েনি? নাকি তাদের কোনো শিক্ষক ছিল না? কিংবা তাদের যে সব শিক্ষকেরা শিক্ষা দান করেছেন তাদের কতটা লজ্জা লেগেছে তাদের ছাত্রদের এই সব কর্মকাণ্ড দেখে? জানি না এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না কি না।

সর্বোপরি বলতে চাই, আমরা যেখানে যে যেই পদই অলঙ্কৃত করি না কেন তার পেছনে রয়েছে আমাদের শিক্ষকদের অবদান। যে দেশে শিক্ষকের সম্মান যত বেশি, সেই দেশ তত বেশি সভ্য এবং উন্নত। শিক্ষক লাঞ্ছনার যে ধারা চালু হয়েছে তার মূল উদ্দেশ্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে অকার্যকর করা, রাষ্ট্রকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করা।

স্বভাবতই রাষ্ট্র যখন মেধা ও নেতৃত্ব শূন্য হয় তখন তা একটি ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত নয়। তাই সময় থাকতে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে আমাদের এই রূঢ় সত্যটি উপলব্ধি করে শিক্ষক লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে রুখে দাঁড়াতে হবে।  

মনিরা নাজমী জাহান ।। শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়