‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’
যশোরে শ্বশুরবাড়ি হওয়ার সুবাদে ঢাকা থেকে সড়ক পথে প্রায়ই সেখানে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। এমনিতে ঢাকার বাইরে গেলে ভালোই লাগে। সবুজ গ্রামগুলো, মানুষের জীবন-সংগ্রাম, নদী, কাশবন, উন্মুক্ত আকাশ সবকিছুই চমৎকার। আমাদের এই সবুজ বাংলার সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না।
কিন্তু এর মাঝে মন খারাপের অনেক বিষয়ও ছিল। দৌলতদিয়া ঘাটে একবার এক অ্যাম্বুলেন্সে এক প্রসূতি মায়ের কাতরধ্বনি আর সঙ্গের লোকদের অসহায় ছোটাছুটি দেখে নিজেকেও খুব অসহায় লাগছিল। ফেরিটা আসতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেরি হচ্ছিল, কারণ ওটা শুকনো মৌসুমের নদীর ডুবোচরে আটকে গিয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
অন্য ফেরিগুলোর কোনো একটা আসবে। কিন্তু সেই মায়ের যে কষ্টটা সহ্য হচ্ছিল না। কিছু জটিলতা হয়তো ছিল। তাই তাকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়েছে। মাগুরা থেকে রওনা হয়ে অ্যাম্বুলেন্সটিকে কুমারখালির ফেরিতে উঠতে হয়নি, কারণ তার কিছুদিন আগেই সেখানে একটা সেতু হয়েছে। অনেকেই বলছিল, ইস্ এখানেও যদি একটা ব্রিজ হতো। কোনো সরকার যদি এটা করতো তাহলে এরকম হাজার হাজার রোগীর উপকার হতো।
আরেকবার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে প্রভাষক নেওয়া হবে। আমার এক ছাত্রও আবেদন করেছে। এক শীতের সকালে প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার সিলেকশন বোর্ডে আমিও আছি। সবার ইন্টারভিউ নেওয়া শেষ, কিন্তু আমার ছাত্রটি তখনো আসেনি। যারা আবেদন করেছে তাদের তুলনায় সে অনেক ভালো ছাত্র, রেজাল্ট ভালো, ভালো জার্নালে পাবলিকেশনও আছে দু’টো।
এখন ভাইবাটা ভালো হলে সেও নিয়োগ পাবে বলে আমি নিশ্চিত। কিন্তু ছেলেটি ইন্টারভিউতে না এলে তো ওর চাকরিটা হবে না। মোবাইলে ফোন দিয়ে জানা গেলো সে আরিচাঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষার যানজটে তখনো বসে আছে। ওর চাকরিটা হয়নি। পরে ঢাকা ফিরে এসে জানলাম তার নাকি চাকরিটা সাংসারিক কারণেই খুব দরকার ছিল। অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞাপন না হওয়াতে সে অবশেষে একটি ওষুধ কোম্পানিতে যোগ দেয়। অথচ তার শিক্ষক হওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল।
ফেরি নিয়ে এরকম সমস্যা অনেকবার দেখেছি। আমিও একবার দৌলতদিয়া ঘাটে সাড়ে ছয় ঘণ্টা বসেছিলাম। তবে তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিল কখনো কখনো মালবোঝাই ট্রাকের দীর্ঘ সারি দিনের পর দিন পড়ে থাকতো। পত্রিকায় ছবিসহ খবর আসতো যে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকে ট্রাকের মালামালগুলো পচে যাচ্ছে।
ঈদের সময়তো মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের শেষ থাকে না। অনেককেই আগের দিন রওনা হয়ে দীর্ঘ সারির কারণে আরিচা বা পাটুরিয়া ফেরিঘাটের পাশে ঈদের জামাত পড়তে হতো। একবার যশোরের বাসার পাশ দিয়ে এক বৃদ্ধ কৃষক ভ্যানে তরতাজা সব সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য যাচ্ছিলেন। শিংনাথ বেগুনগুলোর চকচকে চেহারা দেখে বেগুনের চিকনভাজি খাওয়ার খুব লোভ হলো।
আমার গিন্নিও বেগুনগুলো দেখে খুব খুশি। দাম দেওয়ার সময় বিক্রেতা প্রতি কেজির দাম চাইলেন ৪ টাকা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক কেজি ৪ টাকা’! তিনি আমার বিস্ময়কে বুঝতে না পেরে বললেন, ‘বাবা, আমি এর কমে দিতে পারবো না’। তিনি ভুল করে আমার বিস্ময়ের ভিন্ন অর্থ করেছিলেন। আমার বিস্মিত হওয়ার কারণ ছিল যে কয়েকদিন আগেই আমি পলাশী বাজার থেকে এই শিংনাথ বেগুন ৪০ টাকা কেজি দামে কিনেছি।
পরে বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় কৃষকেরা সবজির সঠিক দাম পান না, আবার ঢাকায় যেতে যেতে যাতায়াতের অসুবিধা, খরচ ও রাস্তায় বিভিন্ন চাঁদাবাজির কারণে সবজির দাম ১০-১২ গুণ হয়ে যায়। পদ্মায় একটা সেতু থাকলে এখানকার কৃষকরা তাদের সব পণ্যেরই ভালো দাম পেত।
আরেকবার জেনারেল এরশাদের আমলে তো আমি ডুবে মরার হাত থেকে দৈবাৎ বেঁচে গেছি। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্য। স্ত্রীকে নিয়ে যশোর এসেছি বেড়াব বলে। হঠাৎ এক শেষ বিকেলে উপাচার্যের জরুরি তলব। পরদিন বিকেলেই সিন্ডিকেটের জরুরি সভা। বিষয়টা আসলেই অতি জরুরি ছিল। সেই রাতেই নাইট কোচে রওনা হলাম, কারণ সকালে বিমানে যাওয়ার কোনো টিকিট অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া সেটা বেশ খরচসাপেক্ষও বটে।
আকাশ ভালো ছিল না। থেকে থেকে ঝড়ো হাওয়া। নদীবন্দরগুলোতে ছিল ১ নং সিগন্যাল। শেষ মুহূর্ত বলে চেয়ার কোচের টিকিটও নেই। অগত্যা লঞ্চ পারাপারের বাসেই রওনা হতে হলো। ঝিনাইদহ হয়ে মাগুড়া পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। কুমারখালির ফেরিতে বাতাসের কিছু ঝাপটা ছিল, তবে সহনীয়। কিন্তু সমস্যা হলো দৌলতদিয়া থেকে লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণ পর। শোঁ শোঁ বাতাসের সঙ্গে বড় বড় ফেঁপে ওঠা ঢেউ। লঞ্চ ভীষণভাবে দুলছিল। আরিচাঘাটের বাতি অনেকক্ষণ আগেই দেখা গেলেও প্রবল স্রোতের কারণে লঞ্চ খুবই ধীরে এগুচ্ছিল।
মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল বাতাসের প্রবল ধাক্কায় লঞ্চ বোধ হয় কাত হয়ে ডুবে যাবে। সেই গভীর রাতে নারী ও বাচ্চাদের কারো কারো কান্না, পুরুষদের আজান আর কলেমা পাঠ, আমাদের দুরু দুরু বুক সব মিলিয়ে এক ভীতিকর অবস্থা। সেবার আমাদেরকে আল্লাহতায়ালা দয়া করে বাঁচিয়েছিলেন, কে জানে হয়তো বা কয়েকজন সৎ ও পরহেজগার লোক লঞ্চে ছিলেন বলেই।
পদ্মা সেতুটি যে মানুষের কী রকম আকাঙ্ক্ষার বস্তু ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। পদ্মা সেতু নির্মাণের সরকারি সিদ্ধান্তটি শুনে মানুষ অসম্ভব খুশি হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি তো বটেই। আমার কেবলই সেতু না থাকাতে ফেরি বা লঞ্চ পারাপারের বিভিন্ন নেতিবাচক চিত্রগুলোর কথা মনে পড়ছিল।
আরো অবাক বিস্ময়ে ভাবছিলাম শেখ হাসিনার সরকারকে যেভাবে একের পর এক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে, এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু হবে তো! কিন্তু দেখা গেল যে বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর মতোই পদ্মা সেতুর দিকে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।
প্রথম বড় ধাক্কাটি আসে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত এতগুলো বছরে এই ব্যাংকটি গরিব দেশগুলোতে এমন কোনো প্রকল্প করেছে যার ফলে কোনো গরিব দেশ সত্যিকারভাবে উন্নতি করেছে বলে শুনিনি। ভবিষ্যতে শুনতে পাবো কি না তাও নিশ্চিত নই। কারণ তারা গরিবের স্বার্থ দেখার চাইতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতেই বেশি উদগ্রীব।
তবুও তখন শুনে ভালো লেগেছিল যে অন্যদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকও পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করবে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক যখন কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন করবে না বলে জানালো তখন খুবই খারাপ লেগেছিল। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আরো দাতা সংস্থাও অপারগতা প্রকাশ করলো। কিন্তু নেত্রী যখন বললেন কেউ সাহায্য করতে না এলেও নিজেদের টাকায় বাংলাদেশে পদ্মা সেতু হবে তখন আমরা আবার আশায় বুক বেঁধেছিলাম।
আমার এক অর্থনীতিবিদ বন্ধু তখন নেত্রীর সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে বলেছিলেন যে এ রকম একটি ঘটনা নাকি মালয়েশিয়াতেও হয়েছিল। সেখানকার একটি খুব বড় সেতুর অর্থায়নে প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিশ্বব্যাংক কথা রাখেনি, কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ মতো মাহাথির মোহাম্মদ চলছিলেন না। তিনি তাদের কথা শোনার চাইতে দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছিলেন।
বিশ্বব্যাংক যে প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না, সেই প্রকল্পে অন্য দাতা সংস্থাগুলোও হয়তো চাপে পড়েই অর্থায়ন করতে সম্মত হয়নি। তখন মাহাথির মোহাম্মদও নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেতুটা করবেন-ই এবং নিজেদের টাকায়ই তা করবেন। তিনি দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের স্বর্ণালংকারগুলো সরকারের কাছে জমা নেন, তার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করেন এবং সেতু নির্মাণ করেন।
আমাদের মাহাথির নেই। কিন্তু আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছেন। তার ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো’ নয়, বরং গ্রেনেড ছড়ানো। বারবার তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরতে হয়েছে। এবং বেঁচে ফিরে দমে যাননি। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে গৃহকোণবাসী হয়ে যাননি। বরং বিপুল তেজে, প্রবল বিক্রমে আর অমিত সাহসে তিনি আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর বিরুদ্ধে ও দেশ গঠনে। কোনো কিছুই তার বাধা হতে পারেনি। পাকিস্তানের পাঠানো ভয়ংকর আর্জেস গ্রেনেড না, তার সভাস্থলে পুঁতে রাখা ৭৮ কেজি ওজনের কোনো বোমাও না। তাই আমার মতে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জটা ছিল আরো কঠিন।
মাহাথির মোহাম্মদ সেতুর তহবিল সংগ্রহের জন্য স্বর্ণ সংগ্রহ করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বর্ণ জোগাড় ছাড়াই তহবিল সংগ্রহ করতে হয়েছিল। আরো চ্যালেঞ্জ ছিল যে বিএনপি-জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলোই শুধু ঠাট্টা-মশকরাসহ এর বিরোধিতা করছিল না, কয়েকটি বড় পাঠক সংখ্যার পত্রিকাকেও ষড়যন্ত্রকারীরা সঙ্গে পেয়েছিল। নোবেল পাওয়া ব্যক্তিটিও তাদের সঙ্গে ছিলেন এবং নেতৃত্বেই ছিলেন। তারা সবাই মিলে বিষয়টা এমন কঠিন করে তুললেন যে সেতুর স্বপ্ন দেখাটাই যেন অসম্ভব হয়ে গেল।
দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও পরবর্তীতে কানাডার আদালত এই অভিযোগটিকে নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশকে নির্দোষ বলে রায় দেয়। যে সেতুর কাজ দূরের কথা ডিজাইনিংই শুরু হয়নি, সেখানে দুর্নীতির কথা আসে কীভাবে! পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়ে জনগণকে আসল কথা জানিয়েছেন যে, বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠানকে পদ্মা সেতুর কাজ দেওয়ার জন্য বলেছিল।
নিয়মানুগ না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাকে কাজ না দিয়ে আরো কম খরচে কাজটি অন্য সংস্থাকে দিয়ে সঠিক কাজটিই করেছিলেন। এতে বিশ্বব্যাংকের খুব গোস্যা হওয়াই স্বাভাবিক এবং অছিলা হিসেবে উল্টো সরকারের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দুর্নীতির অগ্রিম অভিযোগ আনে। কারণ তারা সবসময় ‘জ্বি হুজুর’ শুনতেই অভ্যস্ত। কিন্তু কেউ কেউ যে মেরুদণ্ড সোজা ও মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারে তা তাদের কল্পনাতেও আসেনি। তাছাড়া বেশ কিছু বশংবদ রাজনীতিক ও বিখ্যাত ব্যক্তির সমর্থন তো তাদের ছিলই।
মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে হেয় করার অপচেষ্টার অভিযোগে আমাদের এখন উচিত বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা এবং ক্ষতিপূরণ চাওয়া। কোনো একটি নির্দিষ্ট সংস্থাকে কাজ দিতে বলে দুর্নীতি করেছে তো বিশ্বব্যাংক, অথচ দোষী বানানোর চেষ্টা করলো বাংলাদেশ সরকারকে! এর একটা বিচার তো হওয়াই উচিত।
এখন সেতু নির্মাণ হয়ে গেলেও বিশ্বব্যাংকের কাছে এর নির্মাণের বিরুদ্ধে যারা ক্রমাগত ধরনা দিচ্ছিল তারা কিন্তু এখনো ক্লান্ত হয়নি। তারা তখন বলছিল ‘তারা কোথাও টাকা পাবে না, তাই পদ্মা সেতু হবে না’; ‘সেতু জোড়াতালি দিয়ে হচ্ছে, তাই সেতুতে ওঠা নিরাপদ হবে না’; ‘ওদের সেতু যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে’; ‘আমাদেরকে ক্ষমতায় বসান, আমরা দুটি পদ্মা সেতু বানাবো’ ইত্যাদি।
যখন অর্থের সংস্থান হয়ে গেল তখন তারা বললো ‘নরবলি দেওয়া ছাড়া পদ্মা সেতু হবে না, পদ্মা সেতু মানুষের কাটা মাথা চায়’। এখন তারা বলছে, ‘সেতু নির্মাণে আর্থিক দুর্নীতি নাকি ব্যাপকভাবে হয়েছে, সেজন্য তাদের গায়ে জ্বালা হচ্ছে; সেতুতে রেলপথ কেন, রেলে কে ওঠবে, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ রেলগাড়ি চড়ে না; বিএনপি নেত্রীই পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন’ ইত্যাদি। মানুষের জীবনে যেহেতু হাস্যরসের প্রয়োজন আছে, সেহেতু তারা যে তাদের কথার মাধ্যমে মানুষকে হাসাচ্ছেন তাও বা কম কি!
সরকারি ঘোষণায় আছে এই সেতুটি নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা যদি ধ্বংসাত্মকভাবে খরস্রোতা না হতো তাহলে নদী শাসনের বিপুল ব্যয় প্রয়োজন হতো না এবং তখন হয়তো একাধিক অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের খরচ বাদ দিলে মূল সেতুর খরচ দাঁড়াতো এর প্রায় অর্ধেক। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা প্রথমে বললো খরচ হয়েছে ৪০ হাজার কোটি, তার কয়েকদিন পর ৫০ হাজার কোটি, এভাবে এখন বলছে ৭০ হাজার কোটি! কথায় আছে ‘স্বপ্নেই যখন পোলাও খাবো, তখন ঘি আর কম দেব কেনো’? তাদের মনোভাবটা সে রকমই যে, অপবাদই যখন দেব তখন সংখ্যাটা বাড়িয়ে বলাই ভালো।
বিশ্বব্যাংক এখন স্বীকার করেছে যে, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করতে অস্বীকার করে তারা ভুল করেছে। তবু ভালো যে তারা ভুল স্বীকার করেছে। বিশ্বব্যাংক যখন ভুল স্বীকার করেছে, তখন আমাদের দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরাও যদি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতো তাহলে জনগণ হয়তো তাদের ক্ষমা করতো। কারণ ইতিহাস বলে, বাঙালি অনেক উদার জাতি। অবশ্য তখন আবার তাদের ‘কথামৃত হাস্যরস’ থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম!
বঙ্গবন্ধুকন্যা সেতুর কাজ শুরু করেছিলেন ২০১৫ সালের শেষের দিকে। আজ ঠিক ৫ বছর পরে আমরা পদ্মা সেতুটি সম্পূর্ণ অবস্থায় পেয়েছি। এত অপ-রাজনীতি, ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতা থাকার পরেও ৬ কিলোমিটারের বেশি একটি সেতু আমরা মাত্র ৫ বছরে পেয়েছি তা একটা বিরাট সাফল্য। বিশেষ করে পদ্মার মতো প্রতি বছর ব্যাপক এলাকায় পাড়-ভাঙা এবং ক্রমাগত দিক বদলকারী একটা নদীকে শাসন করে বিশ্বের তীব্র খরস্রোতা নদীর উপর দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতুটি নির্মাণ করা সহজ কথা নয়। কিন্তু শেখ হাসিনার অতুল সাহস বাংলাদেশকে একটা অসম্ভবকে সম্ভব করাতে পেরেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন নেত্রী এই সেতুটির নির্মাণ আরো আগেই শেষ করতে পারতেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছরে কাজ অনেক ধীরে করতে হয়েছে। তাছাড়া তীব্র বন্যার আক্রমণও এর মাঝে হয়েছে। আরো কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা ছিল। এর মধ্যে প্রধানগুলো হলো সেতুটির পিলারগুলো অনেক গভীরে প্রবিষ্ট করানো হলেও ২২টি পিলারের নিচে শক্ত মাটি ও পাথরের ভিত্তির বদলে নরম মাটি পাওয়া গিয়েছিল, যার ফলে ওগুলোকে নকশা বদলো আরো অনেক গভীরে প্রবেশ করাতে হয়। তাছাড়া তীব্র খরস্রোতা হওয়ার কারণে নদী শাসনের কাজেও অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় হয়েছে।
বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যার মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণ সমাপ্ত করাতে অত্যন্ত খুশি। কিন্তু মানুষের এই খুশির যাতে রাশ টানা যায় বা যাতে জনগণের মনোযোগ পদ্মা সেতুর সাফল্যের দিকে নিবদ্ধ না হয়ে অন্যদিকে যায় এবং সম্ভব হলে মানুষ যাতে বিক্ষুব্ধ হয়, ষড়যন্ত্রকারীরা তার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমার ধারণা বোরোর এই ভরা মৌসুমে প্রতিবারের নিয়মে চালের দাম না কমে বরং মূল্যবৃদ্ধি, ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম বৃদ্ধি, এসবই সেই ষড়যন্ত্রের ফসল। পাইকারি বাজারে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী অপ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো পণ্যের দাম বাড়ালে অন্যরাও অতিরিক্ত মুনাফার লোভে তার দাম বাড়ায়। অসাধু সিন্ডিকেটগুলোর ষড়যন্ত্র এভাবেই সফল হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দেওয়া একটা ভাওতা মাত্র।
আমার ঘোরতর সন্দেহ, সীতাকুণ্ডের কনটেইনার গোডাউনে রাসায়নিক বিস্ফোরণজনিত ভয়াবহ আগুনে এখন পর্যন্ত অর্ধশত প্রাণহানি ও সম্পত্তি বিনষ্টের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো পরিকল্পিত স্যাবোটাজ কাজ করেছে। সম্ভবত বিদেশে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারকে ধ্বংস করাই এর মূল উদ্দেশ্য। তবে বিশ্বাস করি সরকার দ্রুতই এসব ষড়যন্ত্র পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা যে তিনি হাজারো প্রতীক‚ লতার মধ্যেও অদম্য সাহসী হয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ করেছেন এবং এর মাধ্যমে বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ শেষ করে আরেকটি মহা কর্মযজ্ঞ শুরু করতে যাচ্ছেন। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী এই সেতুর নামটি তিনি যদি তার নামে হওয়ার অনুমোদন করতেন তাহলে এটি তার অদম্য সাহসের একটি প্রতীক হিসেবে প্রতিভাত হতো এবং তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার একটি সত্যিকারের প্রকাশ ঘটতো। কিন্তু তিনি তা না করে নদীর নামে এর নাম অনুমোদন করে আবারও বিশাল মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর দেশের বার্ষিক জিডিপি গড়ে ২ পয়েন্ট বেড়েছে। কিন্তু এই সেতুটি চালু হওয়ার এত বছর পরেও এর দুই পাড়ে শিল্প-কারখানা বা ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে ওঠেনি। তাতেই যদি জিডিপি গড়ে ২ পয়েন্ট বাড়ে তাহলে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর তা গড়ে ৩ বা তারও বেশি বাড়ার কথা। কারণ এই সেতু চালুর আগেই সেতু-পরবর্তী বিবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরুর আলামত দেখা যাচ্ছে এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য এর সবগুলো রোডের আশেপাশের জমিগুলো আগেভাগেই প্রায় ১৫-২০ গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়ে গেছে।
শোনা যাচ্ছে, পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে জমিগুলো যারা কিনেছে তারা শিল্প-কারখানা বসাবে, বিশাল এলাকায় দুটি তাঁতপল্লী হবে, বিশ্ববিদ্যালয় হবে, মেডিকেল কলেজ হবে, হাসপাতাল হবে, শিক্ষাপল্লী গড়ে তোলা হবে, গার্মেন্টস পল্লী হবে, ফলে ঢাকার ওপর গার্মেন্টসের চাপ কমবে, কারিগরি ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হবে। এগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হবে প্রায় লাখ লাখ মানুষের।
আশা করা যায় যে, এর সবই নির্মিত হবে খুবই সুশৃংখল ও পরিকল্পনা মাফিক। এতকাল যে এলাকাগুলো ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে-শিক্ষায় অনগ্রসর, পদ্মা সেতুর কারণে সেগুলো এখন অগ্রসর ও আলোকিত এলাকায় রূপান্তরিত হবে। সম্ভবত বর্তমানের সমৃদ্ধ জেলাগুলোর চাইতেও সমৃদ্ধতর হবে এসব জেলা। সমগ্র জাতি এর দ্বারা উপকৃত হবে।
মানিক বন্দোপাধ্যায় যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন। তার পদ্মা নদীর মাঝির পাত্রপাত্রীরা যে নতুন দেশ ও নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতো, যার জন্য তারা নিজের দেশ ছেড়ে অজানার জগতে পাড়ি জমাতেও কুণ্ঠিত হতো না, দারিদ্র্য যাদের ছিল নিত্যসঙ্গী, তাদের সহ দুই পাড়ের কোটি কোটি মানুষ আজ আনন্দ-বন্যায় ভাসছে। তাদের এলাকার ‘শেখের বেটি’ আজ তাদের সবার জন্য এক সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ জীবনের সোপান তৈরি করে দিয়েছেন।
পদ্মা নদীর মাঝিদের সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন আজ বাস্তবায়নের পথে এবং তা শুধু মাঝিদের জন্য নয়, বরং সবার জন্য। এবং তা কুবেরের কথামতো নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে নয়, বিদেশে গিয়ে নয় বরং বর্তমান শতাব্দীর দুর্জয় সাহসী-কন্যার কল্যাণে নিজ ভূমিতে নিজ গ্রামে নিজ জেলায় থেকেই। এ দুর্দমনীয় সাহসের কারণেই শেখ হাসিনার সরকার, বারবার দরকার। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয়তু শেখ হাসিনা।
জেডএস