শিক্ষক লাঞ্ছনায় সবাই নিশ্চুপ কেন?
আমরা সবাই অসাম্প্রদায়িকতা বা পরমতসহিষ্ণুতার অনেক বড় বড় লেকচার দেই। কিন্তু আমরা দেখছি বা জানছি ধাপে ধাপে দেশ কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি দেশের বড় অংশের মানসিকতা দেখতে চান, আপনাকে বেশিদূর যেতে হবে না, শুধু যেকোনো সংখ্যালঘু এবং ভারতের সাথে সংস্পর্শ আছে এমন কোনো নিউজের নিচে কমেন্টগুলোর দিকে দৃষ্টি দিবেন। তবে কাউকে আর বোঝাতে হবে না, নিজেই বুঝে যাবেন দেশ কোন অজানা তেঁতুলতলার পথে যাচ্ছে।
শুধু সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মুক্তবুদ্ধির চর্চা যারা করেছেন, যারা জাতির বিবেক বলে খ্যাত, সেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী দেশের এই কৃতি সন্তানদের মৃত্যুর সংবাদে জাতীয় দৈনিক পত্রিকার অনলাইন নিউজ ফিডের নিচে কমেন্ট দেখে আমাদের আঁতকে উঠতে হয়।
বিজ্ঞাপন
অজানা একটা ভয় কাজ করে। চারপাশকে অপরিচিত মনে হয়। খ্যাতিমান শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার করোনা আক্রান্তের সংবাদের নিচে, কিছু মানুষ নামধারী দুইপায়ী জন্তুর বিকৃত আনন্দ উল্লাসে আমাদের ভাষা হারিয়ে যায়। বন্যার অপরাধ, তিনি কেন সংস্কৃতি চর্চা করেন? রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করেন? এবং কপালে কেন লাল টিপ পরেন ইত্যাদি।
২০২০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি ছিলেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল (ইইই) বিভাগীয় প্রধান, সেই অনুষদের ডিন, একাধিক হলের প্রভোস্ট এবং বুয়েট ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক।
এছাড়াও তিনি সার্ক ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স-এর টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়ন পরামর্শদাতা হিসেবে এবং ডিপিডিসি এবং বিটিসিএল-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য।
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ ১০০টিরও বেশি এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং থিসিস এবং ৬টি পিএইচডি গবেষণাগার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০টিরও অধিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ, রেফার্ড জার্নাল এবং কনফারেন্স প্রসিডিংস প্রকাশ করেছেন।
ড. সত্য প্রসাদ মজুমদারের একাডেমিক ক্যারিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হকসহ দেশের প্রায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের থেকেই সম্ভবত বেশি। কিন্তু এরপরেও বিধি বাম, কারণ তিনি এদেশে সংখ্যালঘু।
যোগ্যতা থাকার পরেও নিউজ ফিডে নোংরা মন্তব্যে সয়লাব। প্রশ্ন হলো, প্রশাসন এইসব দেখেও নীরব থাকে কীভাবে? পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট কি এইসব দেখে না? তা অবশ্য দেখে না বললেই চলে। দেখবে কোনটা? কারো নামে যখন ফেক আইডি বানিয়ে পোস্ট করা হয় তখন তাকে ধরেই নিয়ে যাওয়া হয়। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার রসরাজের ক্ষেত্রে হয়েছে। ভোলার বোরহানউদ্দিনের বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য’র ক্ষেত্রে হয়েছে। দুই জায়গায়ই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু ভুক্তভোগী হয়েছে রসরাজ আর বিপ্লব।
বর্তমানে পূর্বের মতো ফেক আইডি নেই। অধিকাংশ আইডিই রিয়েল। যারা অশ্লীল কমেন্ট করছে, তাদের অনেকের টাইমলাইনে গিয়ে দেখলাম, তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক। উপলব্ধি করলাম, একটি অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে ব্যক্তিগত সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি চরিতার্থ করছে এরা।
ভারতের উত্তর প্রদেশে এক সংখ্যালঘু হত্যাকে কেন্দ্র করে ভারতে রাষ্ট্রযন্ত্রের অসহিষ্ণুতার অভিযোগে সেখানকার অসংখ্য সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা। তারা তাদের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার ফেরত দিয়ে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এত এত সংখ্যালঘু নির্যাতন, হত্যায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ বা তাদের পুরস্কার ফেরত দেওয়াতো দূরে থাক, সামান্য টুঁ শব্দও করেন না। পাছে তাদের সুযোগ সুবিধা হাতছাড়া হয়।
শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের অপরাধ কী? কেন শিক্ষককে প্রহার ও জুতার মালা পরানো হলো? এর আসলে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
দেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন হলে শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক আবুল বারাকাত, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসদের মতো কয়েকজনকে বাদ দিলে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী নামধারীদের মুখমণ্ডলেই বিরাজ করে শ্মশানের নীরবতা। এই সময়ে এরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। দেশীয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া কথিত জাতির বিবেকদের টকশো’তে টকাশ-টকাশ কথা বলা ছাড়া আর খুঁজেও পাওয়া যায় না।
২০১৬ সালে দেখেছি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরোহিত, মন্দিরের সেবায়েত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, পাদ্রি, ব্যবসায়ী, কলেজ শিক্ষক, কবিরাজসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অকারণে হিংস্র শ্বাপদের চাপাতির শিকারে পরিণত হয়েছিলেন।
একটু সচেতনভাবে কান পাতলে টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা দেশে এখনো কতটা সক্রিয়। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
২০২২ সালে এসেও সংখ্যালঘু ছাত্র এবং শিক্ষকের ভবিতব্য একই বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে। ঘটনাগুলোর স্বরূপ হয়তো আলাদা। কিন্তু মূলভাব একই। ১৭ জুন ২০২২ নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় নিজের ফেসবুক আইডিতে, বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সাম্প্রতিক আলোচনায় থাকা ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করে।
নড়াইলের ওই কলেজের ছাত্র পোস্ট দেওয়ার পরদিন কলেজে গেলে কিছু ছাত্র তাকে সেটি মুছে ফেলতে বলে। এই পোস্টকে কেন্দ্র করেই ওঠে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ। এর জেরেই গুজব ছড়িয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পড়ানো হয় জুতার মালা।
ধরে নিলাম, নূপুর শর্মার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে, তাকে প্রণাম জানিয়ে ছাত্র রাহুল দেব রায় না হয় অপরাধ করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের অপরাধ কী? কেন শিক্ষককে প্রহার ও জুতার মালা পরানো হলো? এর আসলে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
শিক্ষক নাকি ধর্ম অবমাননা করেছেন। হায়রে ধর্ম অবমাননা! এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষক ছাত্রদের নড়াচড়া করলেও ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আসে। বিষয়টি অত্যন্ত সাংঘাতিক এবং গুরুতর।
১৮ জুন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির সাথে সাথেই শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় থানায় ফোন করেন। থানায় ফোন করাই নাকি তার অপরাধ হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ধর্মের অবমাননা হয়েছে। থানায় পুলিশের কাছে ফোন দিয়ে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস নাকি ঐ অভিযুক্ত ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন।
জানি না পুলিশেরও তাই ভাষ্য কি না! পুলিশেরও যদি সেই ভাষ্য নাই হয়, তবে থানায় ফোন করার কারণে স্বপন কুমারকে যখন শিক্ষার্থীরা জুতার মালা পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা কেন এর প্রতিবাদ করেনি? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সামনেই শিক্ষক স্বপন কুমারের মানসম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে এক প্রকার মানসিকভাবে হত্যাই করে তাকে।
অপমানকে হত্যা বলাই সঙ্গত, কারণ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীসহ হাজার হাজার মানুষের সামনে একজন শিক্ষককে বিনা দোষে নির্যাতন ও জুতার মালা পরিয়ে তা আবার গর্বের সাথে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হত্যা ছাড়া কিছুই নয়।
এই অপমানকে হত্যা বলাই সঙ্গত, কারণ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীসহ হাজার হাজার মানুষের সামনে একজন শিক্ষককে বিনা দোষে নির্যাতন ও জুতার মালা পরিয়ে তা আবার গর্বের সাথে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হত্যা ছাড়া কিছুই নয়। ঘটনাটি শিক্ষক-ছাত্রের স্বাভাবিক সম্পর্ককেও হত্যা করেছে।
শিক্ষকের নির্যাতন প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কলেজ ভবন থেকে অভিযুক্তদের বের করে আনার সময় উত্তেজিত জনতার হাত থেকে অধ্যক্ষ ও শিক্ষার্থীকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ হয়তো জুতার মালা পরানোর বিষয় লক্ষ্য করেনি। জুতার মালা পরানোর দু’একটি ছবি দেখেছি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কলেজের ক্যাম্পাসে রাখা শিক্ষকদের তিনটি বাইকে আগুন ধরিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস ছাড়াও শিক্ষক প্রশান্ত কুমার রায় ও অজিত কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করা হয়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষক স্বপন কুমারের গলায় জুতার মালা পরানোর সময় পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ।
উল্টো হেনস্তার শিকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে রাতারাতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। চূড়ান্ত হেনস্তার বর্ণনা দিয়ে শিক্ষক স্বপন কুমার বলেন, ‘পুলিশ আমাকে কলেজের কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে শত শত পুলিশ ছিল। এর মধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল।’
এভাবে সংঘবদ্ধতার আশ্রয় নিয়ে শিক্ষকের গলায় জুতার মালাই প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কীভাবে পচন ধরে যাচ্ছে। জানি না সেই পচন আমরা কতটা রোধ করতে পারব! ভবিষ্যতই বলে দেবে আমাদের গন্তব্য কোথায়, 'তেঁতুলতলা' নাকি 'সত্যতলা'।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়