পদ্মা সেতু
রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি
আমি আগে থেকেই বলেছি, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য বাঁক বদলকারী স্থাপনা। পদ্মা সেতুর আগের বাংলাদেশ আর পরের বাংলাদেশ এক থাকবে না। এটা বলেছিলাম ইতিবাচক অর্থে। সব বিবেচনাতেই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দিন বদলের প্রতীক।
পদ্মা সেতু আমাদের গর্ব, অহংকার, সক্ষমতা, সামর্থ্যের প্রতীক। কিন্তু এই পদ্মা সেতুতে বাঙালির কর্মকাণ্ড যে গোটা বিশ্বের সামনে আমাদের মাথা হেঁট করে দেবে তা সত্যি আমি কল্পনা করতে পারিনি।
বিজ্ঞাপন
২৫ জুন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন এবং পরদিন সবার জন্য খুলে দেওয়ার পর পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা যা করেছি; তাতে বিশ্বের মানুষ হাসাহাসি করছে। এ যেন এক গণ উন্মাদনা।
এটা মানতে দ্বিধা নেই, মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু। সেই সেতু নিয়ে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস, একটু আদিখ্যেতা থাকতেই পারে। কিন্তু সেই ভালোবাসা যখন উন্মাদনায় বদলে যায়, তখন মানুষ সেটাকে আর মর্যাদা দেয় না, হাসাহাসি করে।
সীমা লঙ্ঘনকারীকে স্রষ্টাও পছন্দ করেন না। আর আমরা সবাই মিলে সেদিন সীমা লঙ্ঘনের সীমাটাও ভুলে গিয়েছিলাম। পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তাও জরুরি। সেখানে হাঁটা যাবে না, এটাই স্বাভাবিক।
পদ্মা সেতু আমাদের গর্ব, অহংকার, সক্ষমতা, সামর্থ্যের প্রতীক। কিন্তু এই পদ্মা সেতুতে বাঙালির কর্মকাণ্ড যে গোটা বিশ্বের সামনে আমাদের মাথা হেঁট করে দেবে তা সত্যি আমি কল্পনা করতে পারিনি।
তবুও মানুষের আবেগ বিবেচনা করে সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা প্রথমদিন একটু শিথিল রেখেছিল। কিন্তু সেই শিথিলতার সুযোগে আমরা যা করেছি, তাতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়েছে আমাদের।
পদ্মা সেতু দেখতে গিয়ে মানুষ একটু দাঁড়াতে চাইবে, ছবি তুলতে চাইবে; এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু স্বাধীনতার সুযোগে আমরা যা করেছি, তা অবিশ্বাস্য। সেলফি তোলা, ছবি তোলা, শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দেওয়া, ভিডিও করা, রীতিমতো শুটিং করা, জামাতের সাথে নামাজ পড়া, প্রস্রাব করা, নাট-বল্টু খুলে ফেলা পর্যন্ত আমরা দেখেছি।
আমার শঙ্কা ক্যামেরার আড়ালে আমরা আরও কত কিছু যে করেছি তার সীমা-পরিসীমা নেই। মজার কথা হলো, প্রত্যেক অপকর্মের পক্ষে আবার আমরা অকাট্য যুক্তিও দাঁড় করিয়েছি। আসলেই খলের কখনো ছলের অভাব হয় না। সেলফি তোলা বা ছবি তোলা ঠিক আছে, তাই বলে আপনি নাটকের মতো শুটিং করে ফেলবেন।
যারা পদ্মা সেতুতে প্রস্রাব করেছেন, তাদের পক্ষে যুক্তি হলো, হয়তো তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, হয়তো তার মূত্রজনিত কোনো অসুখ আছে। আরে ভাই, পদ্মা সেতু পার হতে ৬/৭ মিনিট লাগে। এই ৬/৭ মিনিট যারা প্রস্রাব আটকে রাখতে পারেন না, তাদের তো হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত, পদ্মা সেতু তো পাবলিক টয়লেট নয়।
যারা জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেছেন এবং ছবি তোলার জন্য পাশে আবার লোক রেখেছেন; তাদের পক্ষে হাজারটা ধর্মীয় যুক্তি—গোটা বিশ্বই আল্লাহর জমিন। আর নামাজের সময় হলে যেখানে যে অবস্থায় আছেন, সে অবস্থায়ই নামাজ আদায় করতে হয়। পদ্মা সেতু দেখতে গিয়ে হয়তো নামাজের সময় হয়ে গেছে। তাই তারা উপরওয়ালার সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করেছেন।
ইসলামের পাঁচ ফরজের অন্যতম নামাজ। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় নির্ধারিত। তাই আপনি যখন পদ্মা সেতুতে যাবেন, তার আগেই তো নামাজের সময় সম্পর্কে জেনে যাবেন। তারচেয়ে বড় কথা হলো, ৬/৭ মিনিটের মধ্যে কোনো নামাজেরই সময় ফুরিয়ে যাবে না।
এটা মানতে দ্বিধা নেই, মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু। সেই সেতু নিয়ে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস, একটু আদিখ্যেতা থাকতেই পারে।
যারা পদ্মা সেতুতে জামাতে নামাজ আদায় করেছেন, একজন মুসলমান হিসেবে তারা আমার অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। ইসলামকে তারা হাস্যকর করে তুলেছেন। এটা ইবাদত নয়, এটা ফেসবুকে বাহবা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এরা ধার্মিক নয়, এরা ভণ্ড। এরা মূলত ধর্ম ব্যবসায়ী। এরা সব জায়গায় ধর্মকে ব্যবসায় পরিণত করেছে।
এমনকি যিনি বা যারা পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খুলে সেটা ভিডিও করে ভাইরাল হয়ে এখন পুলিশি রিমান্ডে আছেন; তাদের পক্ষেও যুক্তির কমতি নেই। তারা নাকি পদ্মা সেতুর খুঁত ধরিয়ে দিয়েছে সরকারের মহা উপকার করেছেন। তাদের নাকি রিমান্ডে না নিয়ে পুরস্কার দেওয়া দরকার ছিল। আরে ভাই, পদ্মা সেতুর খুঁত ধরার দায়িত্ব তো সরকার আপনাকে দেয়নি।
নাট-বল্টুগুলো যথাযথভাবে টাইট দেওয়া থাকলে ভালো হতো। কর্তৃপক্ষ বলছে, শেষ মুহূর্তে তারা সেই কাজটি শেষ করতে পারেননি। তাই বলে আপনি ঘুরে ঘুরে নাট-বল্টু টাইট কি না, সেটা পরীক্ষা করবেন!
৩০ হাজার কোটি টাকায় বানানো পদ্মা সেতু টিকবে একশ বছর। ৮ মাত্রার ভূমিকম্পও পদ্মা সেতুকে টলাতে পারবে না। সেখানে আপনি একটা দুইটা নাট-বল্টু খুলে ফেললেও সেতুর কিছু হবে না। তবে সাধারণ মানুষকে একটু হলেও বিভ্রান্ত করা গেছে—চাইনিজরা বানিয়েছে, তাই প্রথম দিনেই নাট-বল্টু খুলে পড়ছে।
আসলে এত বড় স্থাপনা আমরা আগে দেখিনি বলে আদিখ্যেতা একটু বেশি। কিন্তু এত বাড়াবাড়ি করেছি যে, এখন চাইলে ভালোবেসে কেউ একটা সেলফিও তুলতে পারবে না।
পদ্মা সেতু নিয়ে আদিখ্যেতায় আরেকটা বিষয় প্রমাণিত, শুধু বড় বড় স্থাপনা বানালেই আমরা স্মার্ট হব না। সত্যিকারের উন্নয়ন আর স্মার্টনেসের জন্য আমাদের মনোজগতেও বড় উন্নয়ন লাগবে।
এই আমাদের কথা ভেবেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী ক’রে, মানুষ কর নি।’
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ