কেন বারবার দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে?
খুবই অস্থির একটা সময় যাচ্ছে। কেমন যেন দমবন্ধ একটা পরিবেশ। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, সবাই এক মহা আতঙ্কে আছে। এই না বুঝি কখন এক নতুন বিপদ নেমে আসে।
প্রত্যেকদিন কিছু না কিছু লেগেই আছে। সীতাকুণ্ডের ভয়াবহ ঘটনা শেষ হতে না হতেই সিলেট আর সুনামগঞ্জের ভয়াবহ বন্যা। একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
একটা জাতির সহ্য ক্ষমতা কত হলে, এত বিপদের পরেও একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। নিজে না খেতে পেয়েও অন্যের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। শুধু সরকারি সাহায্যের উপর নির্ভর না করে, সবাই নিজ দায়িত্বে সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটা দিয়ে প্রমাণিত হয়, এই জাতির মধ্যে মানবতাবোধ শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো, কালকে আবার নতুন কোনো ইস্যু আসলে আবারও নতুন উদ্যমে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ব এবং আগের ইস্যু বেমালুম ভুলে যাব।
এক মুহূর্তেও চিন্তা করে আমরা দেখব না, যে উদ্যমে আমরা প্রতি বছর কষ্ট করে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ছি, হয়তো তার চেয়ে কম উদ্যম নিয়ে, কী কারণে সমস্যার উৎপত্তি, তা একটু খতিয়ে দেখে একবারে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
প্রতিবছর আমাদের দেশে ছোট বড় বন্যা লেগেই আছে। মানব সৃষ্ট কারণের পাশাপাশি আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানও আমাদের অনুকূলে নয়। তাই আমাদের মেনে নিতেই হবে, আমাদের এই বিপদে প্রতিবছরই পড়তে হবে।
প্রতিবছর আমাদের দেশে ছোট বড় বন্যা লেগেই আছে। মানব সৃষ্ট কারণের পাশাপাশি আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানও আমাদের অনুকূলে নয়।
শুধু সরকারের উপর দোষ না চাপিয়ে, এখন যেমন দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছি, তেমনি যে যার নিজ অবস্থান থেকে কী করলে আমরা এই সমস্যা মোকাবিলা করতে পারব তার উদ্যোগ এখনই নেওয়া প্রয়োজন।
বব মার্লের একটা উক্তি আমাদের জন্য খুব প্রযোজ্য, ‘You never know how strong you are, until being strong is the only choice you have.’ অর্থাৎ, ‘আমরা নিজেরাও জানি না, আমরা কতটা শক্তিশালী যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়।’
আমরা সবসময় আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। আর যে মুহূর্তে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন খুব তড়িঘড়ি করে সমস্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা করি এবং অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হই। কিন্তু চাইলেই একটু চিন্তা করে, সময়ের কাজ সময়ে করে আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারি।
এই লেখাটা যখন লিখছি তখন আমার অবস্থান সিঙ্গাপুরে। অফিসের কাজে এসেছি। ছোট্ট একটা দেশ, বাংলাদেশ থেকে ২০০ গুণ ছোট, নিজের বলতে কিছুই নেই।
খাবার পানি থেকে শুরু করে বালি পর্যন্ত সবই আমদানি করতে হয়। জনসংখ্যার ঘনত্বে পৃথিবীতে দ্বিতীয়। বাংলাদেশ থেকে ১০ গুণ বেশি। আমাদের থেকে মাত্র ৬ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু পুরো পৃথিবীতে তাদের জয়জয়কার।
সবকিছুতেই তারা বিশ্বের ১ থেকে ১০ এর মধ্যে। এর একমাত্র কারণ, তাদের নিজেদের সচেতনতা আর একাগ্র ইচ্ছা। ওদের সাফল্যের মূল মন্ত্র কি জানেন? নিজের ঘরের সমস্যা সমাধানে তারা যতটুকু উদ্যমী, দেশের সমস্যা সমাধানে, তারচেয়েও বেশি উদ্যমী।
বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিঙ্গাপুরেও হয়, মানুষ এখানেও মারা যায়। কিন্তু প্রতিবারের ভুলগুলো থেকে তারা শিক্ষা নেয়। পরেরবার যেন একই ভুল না হয় সেই ব্যাপারে তারা খুবই সচেতন।
নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থান ঠিক রাখলে নিজেরও ভালো থাকব। এই জিনিস ওরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিঙ্গাপুরেও হয়, মানুষ এখানেও মারা যায়। কিন্তু প্রতিবারের ভুলগুলো থেকে তারা শিক্ষা নেয়। পরেরবার যেন একই ভুল না হয় সেই ব্যাপারে তারা খুবই সচেতন।
যেমন, সিলেটের বন্যার কিছু কারণ মানবসৃষ্ট এবং কিছু কারণ নিতান্তই প্রাকৃতিক। অর্থাৎ কিছু জিনিস আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আর কিছু জিনিস আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আরও একটু বুঝিয়ে বললে, এবারের বন্যার অন্যতম কারণ চেরাপুঞ্জির অতিবৃষ্টি যেখানে আমাদের খুব একটা করণীয় নেই। যদিও এর অন্যতম কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা যেখানে চাই পুরো পৃথিবীর সম্মেলিত প্রচেষ্টা।
আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, নদীর নাব্যতা বা পানি বহনের ক্ষমতা কমে যাওয়া। এর কারণ কিন্তু মানব সৃষ্ট। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে এবং নদীর তলদেশ ভরে যায়। এর পেছনের আরও কারণগুলো হলো, নদীতে অপ্রয়োজনীয় ময়লা ফেলা, ঠিকমতো ড্রেজিং না করা এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন। চাইলেই কিন্তু মানবসৃষ্ট এই কারণগুলো আমরা রোধ করতে পারি এবং কড়া বিধিনিষেধ দিতে পারি।
এত অনিয়মের মধ্য বন্যা মোকাবিলা করা খুবই কঠিন। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট, যেকোনো দুর্যোগের প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করে তা একবারে সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বারবার যেন আমরা একই ভুল না করি, সেই ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। আর যা করতে হবে তা হচ্ছে, এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করার চেকলিস্ট বা তালিকা তৈরি করা এবং সেই বিষয়ে জনসচেতনতা বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে মানুষের দুর্ভোগ এবং ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশেই কমে যাবে।
আমার মনে হয়, জাতি হিসেবে উদ্যমে আমাদের কোনো কমতি নেই, শুধু দরকার একটু সদিচ্ছা, শৃঙ্খলা আর একটু প্রচেষ্টা। আর জ্ঞানের যে ঘাটতি রয়েছে, তা হয়তো একটু কষ্ট করলেই অর্জন করা যাবে।
ভবিষ্যতে কোনো মানুষকেই আমরা আগুনে পুড়ে, বন্যার পানিতে ডুবে মরতে দেখতে চাই না। স্বপ্ন দেখি, একদিন আমার দেশের মানুষের বিচক্ষণতার গল্প বিশ্বব্যাপী আলোচিত হবে।
শুভাশীষ ভৌমিক ।। কান্ট্রি ডিরেক্টর, অস্ট্রেলিয়ান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি