পদ্মা সেতু : কীর্তিনাশার বুকে অনন্য কীর্তিগাথা
‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা, মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’
- বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম
বিজ্ঞাপন
কীর্তিনাশা পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত ‘পদ্মা সেতু’ আজ সেই স্বপ্নেরই বাস্তব প্রতিমূর্তি। কূল-কিনারাহীন যে নদী ‘সকালবেলা’র ‘আমির’কে ‘সন্ধ্যাবেলায়’ নিঃস্বে পরিণত করেছে। তার গর্ভে, তার গ্রাসে গ্রামের পর গ্রাম, জনপদ ভেসে গেছে, ডুবে গেছে সেই সর্বগ্রাসী রাক্ষসী, রুদ্র- আরও কত কত অভিধার এই নদীর বুকের ওপর অপরাজেয় মানুষেরই আকাঙ্ক্ষার দীপ্ত কীর্তিরূপে আজ সগৌরবে বয়ে যাবে কংক্রিটের ঢেউ-পদ্মা সেতু।
জলের ঢেউয়ের ঝুঁটি বেঁধে দেওয়া এই ইস্পাত, কংক্রিটের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে এপারের মানুষ ওপারে পৌঁছবে, ওপারের মানুষ এপারে। পৌঁছাবে মানুষের জয়গাথা।
যে পদ্মার ঢেউকে সম্বোধন করে কবি নজরুল ‘শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা রে’ বলে প্রিয়াকে হারানোর হাহাকার ব্যক্ত করে সংগীত রচনা করেছিলেন সেই পদ্মার ঢেউ, কংক্রিটে গড়া পদ্মা সেতু পেরিয়ে ‘পূর্ণ হৃদয়’ নিয়ে প্রিয়জনের কাছে পৌঁছবে; এপারের মানুষ ওপারে, ওপারের প্রিয়জন এপারে। পদ্মা সেতু ইস্পাতে-কংক্রিটে রচিত মহাকাব্য।
বারবার নিয়তির হাতে বিধ্বস্ত, প্রকৃতির কাছে মার খাওয়া বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর গৌরব। আমাদের সাহসের স্বাক্ষর, সক্ষমতার উদাহরণ। স্বপ্নের সার্থক রূপায়ণ। নিয়তির কাছে হার না মানা, অদম্য স্বপ্নের কাণ্ডারি বাঙালি জাতি।
আজ মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের উৎসবের পাশাপাশি একই সমান্তরালে সিলেট-সুনামগঞ্জে চলছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার কাজ। ঠিক এইখানটিতেই বাঙালি জাতির অহংকার। আমরা লড়তে জানি, আমরা গড়তে জানি। পদ্মা সেতু বাঙালি জাতির আবহমান সংগ্রামের প্রতীক। যুগে যুগে বাঙালি ধ্বংসস্তূপে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে। এটাই আমাদের প্রাণশক্তি।
আমাদের এক কবি আফসোসে এ পঙক্তি রচনা করেছিলেন- ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে! কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ এই পঙক্তির জবাব আজকের বাংলাদেশ। যখন এ দেশের তরুণরা শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত জনপদে নিজের জীবন বিপন্ন করে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে দুর্গত মানুষের ঘরে, পাশাপাশি আমরা আমাদের স্বপ্নের সেতুটিকে ঘিরে স্মরণ করছি সক্ষমতার শক্তিকে। এই শক্তিই জয়ী করে মানবতাকে।
বাঙালির ছোট-বড় সব উৎসবই মানবতার ডাকে উজ্জীবিত করে বাঙালিকে, পৃথিবীকে। ‘কীর্তিনাশা’ পদ্মার বুকের ওপর তাই ‘পদ্মা সেতু’ বাঙালির অনন্য ‘কীর্তিগাথা’ হয়ে উঠেছে আজ।
২.
কোনো পথ, কোনো স্বপ্নই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না কীর্তিগাথা পদ্মা সেতু নির্মাণের পথও। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ পদ্মা সেতু এক বাস্তবতা। হাজার নদীবিধৌত এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ স্রষ্টার আশীর্বাদে পূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আশীর্বাদের সেই ভূমিকেই যুগে যুগে, কালে কালে অভিশাপ বহন করতে হয়েছে।
এ ভূমির সংগ্রামী মানুষ প্রজন্ম পরম্পরায় বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে প্রকৃতির রুদ্ররোষে। জীবনের অপর নাম যে জল, সেই জলই তাকে বারবার মৃত্যুতে ভাসিয়ে নিয়েছে। স্বপ্নগুলোকে পরিণত করেছে হাহাকারে। পদ্মা সেতু সেই দুঃস্বপ্নের অবসানে মানুষকে উদ্দীপিত করবে জীবন সংগ্রামে। এর দুপারের মানুষের জীবন স্বপ্নের বুননে, বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবে সামনের পানে- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
৩.
পদ্মা সেতু এক স্বপ্নযাত্রার নাম। যে সেতুর কর্মীরা কাজ করেছেন নিরন্তর। মহামারি করোনার সময়ে যখন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সব কাজের আঙিনা; তখনো এর কর্মীরা কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তারা থেমে থাকেননি। যাকে বলে অবিরাম চলা, সেটাই করেছেন তারা। পদ্মা সেতু বাঙালির নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ।
যমুনা নদীর ওপর ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর এই আত্মবিশ্বাস জন্মে যে, দেশের অন্য বড় নদীর ওপরও সেতু নির্মাণ সম্ভব। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতে একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। পদ্মা সেতুর জন্য ১৯৯৯ সালের মে মাসে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শুরু হয়।
এটাই পদ্মা সেতুর সূচনাবিন্দু। তারপর নানা চড়াই-উতরাই পেরোনোর ‘স্বপ্নযাত্রা’ আজকের পদ্মা সেতু। যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ৪ জুলাই। অদম্য নেতৃত্বের এক অপার সাহসী সিদ্ধান্ত।
পরবর্তীকালে ২০০৫ সালে পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমাপ্ত হয়। ২০০৬ সালে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে করণীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ২০০৭-এ ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’ একনেক সভায় অনুমোদন পায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডের ‘মনসেল এইকম’কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুরুতে এ সেতুতে রেল চলাচলের ব্যবস্থা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেল চলাচলের সুবিধাযুক্ত করে নকশা প্রণয়নের নির্দেশনা দেন। ২০১০ সালে সেতুর নকশা চূড়ান্ত হয়।
পদ্মা সেতুর নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে অর্থায়নের বিষয়ে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সেই সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। তারা অভিযোগ তোলে, নির্মাণকাজে তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের সূত্রে অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে দাঁড়ায়। প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবি চলে গেলে মালয়েশিয়ার সরকার এ প্রকল্পে যুক্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু সে প্রস্তাব বেশিদূর এগোয়নি।
সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। মন্ত্রিসভার ২০১২ সালের ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তিনি। এ ছিল এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সেদিন অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে সংশয় নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন।
আজ তাদের সেই প্রশ্ন, সংশয় আর অবিশ্বাসের জবাব হয়ে প্রমত্ত পদ্মার দুই তীরকে ঐক্যসূত্রে গেঁথে দিয়েছে এই সেতু। আমরা পারি আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে- পদ্মা সেতু আজ সেই প্রত্যয়ের সাক্ষী।
পদ্মা সেতু থেকে অর্থায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের সরিয়ে দিয়ে যারা জাতির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন আজ তাদেরও স্বার্থরক্ষা করবে এই সেতু। একেই বোধ করি বলে, ‘নিয়তির পরিহাস’। তার প্রমাণ জাইকার দায়িত্বশীলরাও বলছেন, পদ্মা সেতু থেকে জাইকার সরে যাওয়া ছিল ভুল। অন্যরাও নিশ্চয়ই সেই ভুল উপলব্ধি করবেন। ভুল উপলব্ধি করবেন তারাও, যারা ছিলেন সংশয়ে, অপতৎপরতায় নিয়োজিত।
পদ্মা সেতু আমাদের ভীরুতা, সংশয়, আত্ম-অবিশ্বাসেরও জবাব। কবির ভাষায়, ‘সংকোচের বিহ্বলতায়’ যুগ যুগ ধরে নিজেরে ‘অপমানিত’ করে আসা বাস্তবতার অবসানের প্রতীক।
এক ঔপনিবেশিক শাসকের উক্তি ‘বাঙালি আজ যা ভাবে, গোটা ভারতবর্ষ সেটা ভাবে তার পরদিন।’ স্বভাবতই এই জাতিকে আত্মবিশ্বাসহীনতায় চুবিয়ে রাখার সব রকম শিক্ষা, আয়োজন, ঘিরে আছে আমাদের চারপাশজুড়ে।
আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব, লড়াই করতে পারি- এসব যেন ছিল উপকথার কল্পকাহিনি; যা ছিল সর্বতো মিথ্যা, কিন্তু অজস্র রচনাকার সে মিথ্যা গীত করেছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু প্রকৃত সত্য তো এটাই যে, উপমহাদেশকে মুক্তির স্বপ্নে, স্বাধীনতার সংগ্রামে, সর্বতোভাবে উদ্দীপ্ত করেছে বাঙালিরাই। বারবার সেই সত্যকে মিথ্যায় ঢেকে দেওয়ার অবিরাম চেষ্টা হয়েছে, সে চেষ্টা এখনো চলমান।
১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্টন ময়দানে যে অমর কাব্য উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
অনেক রক্তক্ষয়ে আমরা ১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এখন অনেক স্বপ্নের সংগ্রামে আমরা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে পারব-পদ্মা সেতু সেই যাত্রায় প্রথম পদচিহ্ন।
৪.
পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে কেবল রাজধানী ঢাকা নয়, গোটা দেশের সঙ্গে একই প্রাণস্পন্দনে যুক্ত করবে। অর্থনীতিবিদরা এর আর্থিক মূল্য জানাচ্ছেন, জিডিপিতে ১.২৩ ভাগ প্রবৃদ্ধির উল্লেখ করে। কিন্তু এই সেতুর নৈতিক অবস্থান তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
সারা দেশকে একপ্রাণে স্পন্দিত করার চেতনা বহন করে এই সেতু দেশের আরও বিচ্ছিন্ন যেসব জনপদ রয়েছে, সেগুলোকে একসূত্রে গাঁথার প্রেরণা হবে। এখনো চাঁদপুর-শরীয়তপুর, বরিশাল-ভোলা এবং নদী বিচ্ছিন্ন অন্যান্য স্থানে সেতু নির্মাণ এবং সেসব জনবসতির মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের তাগিদকে জাগিয়ে রাখবে।
আজ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে, আমাদের বাঙালি জাতির মননে যে মনীষার আলো, অবিরাম প্রেরণা জুগিয়ে চলে, সেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাগুলো যেন অন্তরের গহিন দেশ থেকে স্বতোৎসারিত হচ্ছে আমার মনে-
‘অন্তর মন বিকশিত করো অন্তরতর হে
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে॥
জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নিরলস, নিঃসংশয় করো হে॥
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ
সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে সমচিত নিস্পন্দিত করো হে
নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে॥’
সাইফুল আলম ।। সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর; সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব