আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
অর্জন অনেক, চ্যালেঞ্জও কম নয়
মানুষের বয়স বাড়লে আসলে আয়ু কমে। প্রতিটি জন্মদিন মানে জীবন থেকে আরও একটি বছর চলে যাওয়া। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী মানে সংগঠন আরও অভিজ্ঞ হওয়া, আরও দায়িত্বশীল হওয়া। ব্যক্তি চলে যায়, কিন্তু তার আদর্শ বেঁচে থাকে সংগঠনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৩ বছর পূর্ণ হলো আজ। আসলে আওয়ামী লীগের ইতিহাস আর বাংলাদেশের ইতিহাস সমান্তরাল। বাংলাদেশ আর আওয়ামী লীগ যেন একে অপরের পরিপূরক। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশ একটি আলাদা রাষ্ট্রের ধারণার উন্মেষ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই আসে স্বাধীনতা।
বিজ্ঞাপন
শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশেরই অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ভারতের কংগ্রেস, পাকিস্তানের মুসলিম লীগ আর বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ। এই তিনটি দলকে ঘিরেই বিকশিত হয়েছে দেশ তিনটি।
ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের দুই বছরের মাথায় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশাভঙ্গ হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের বন্ধু না হয়ে প্রভু বনে যায়। তাই তো পাকিস্তান গঠনের দুই বছরের মাথায় গড়ে ওঠে আওয়ামী মুসলিম লীগ।
ক্ষমতায় তখন মুসলিম লীগ। আর বিরোধী দল হলো জনগণের মানে আওয়ামী মুসলিম লীগ। তবে গঠনের মাত্র ৬ বছরের মাথায় ১৯৫৫ সালে সংগঠনের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সব মানুষের গণসংগঠনে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ।
তারপর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাত ধরে গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক দেশের ধারণা। ১৯৭০-এর নির্বাচনে যে ধারণার পক্ষে গণরায় পায় এই দল। তবে রায় পেলেও ক্ষমতা পায়নি আওয়ামী লীগ। একাত্তর সালে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস আর বাংলাদেশের ইতিহাস সমান্তরাল। বাংলাদেশ আর আওয়ামী লীগ যেন একে অপরের পরিপূরক। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশ একটি আলাদা রাষ্ট্রের ধারণার উন্মেষ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই আসে স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ নামের স্বপ্নের দেশটি পেলেও তাকে সোনার বাংলায় পরিণত করার মতো সময় পাননি বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনে লড়াই চালাতে চালাতেই মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে প্রাণ দিতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। তারপর ২১ বছরের অন্ধকারের ইতিহাস।
১৯৯৬ সালে জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তার মূল দায়িত্ব ছিল অন্ধকার থেকে বাংলাদেশকে আলোর পথে ফেরানো। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা। তিনি শুরু করেন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই পালাবদল ঘটে যায় ক্ষমতার। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসেন ২০০৯ সালে। তারপর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
স্বাধীন রাষ্ট্রের ভাবনা থেকে তা অর্জন পর্যন্ত পুরোটা পথে নেতৃত্ব, আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছাড়া স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আজ বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে। মাথাপিছু গড় আয়, গড় আয়ু, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ এখন এক বিস্ময়ের নাম। বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। অনেক সূচকে ছাড়িয়ে গেছে ভারতকেও। সমৃদ্ধি, সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে দু’দিন বাদে।
৭৩ বছরের আওয়ামী লীগ আর গত ১৩ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অর্জনের তালিকা অনেক লম্বা। তবে টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে অর্জনের পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জের তালিকাও লম্বা হয়েছে। সরকারের নানা সাফল্য থাকলেও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ বেড়েছে অনেক বেশি।
বিশেষ করে হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়া আওয়ামী লীগের মূল শক্তি তৃণমূলের কপালে চিন্তার ভাঁজ। পরপর দুটি নির্বাচনে অটো জয় পেয়ে যাওয়া নেতাদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগের জিততে ভোট লাগে না, এমন একটি ধারণা দলের মধ্যে আত্মঘাতী প্রবণতা তৈরি করেছে। সরকারের অতিরিক্ত আমলা ও পুলিশ নির্ভরতাও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে। রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়াও এখন আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। নিরলস এই লড়াই তাকে এনে দিয়েছে গণতন্ত্রের মানসকন্যার খেতাব। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনামলেই আজ গণতন্ত্রের জন্য হাহাকার সবচেয়ে বেশি।
যে কারণেই হোক, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ নির্বাচনের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে। ভোটাধিকার না থাকা, গণতান্ত্রিক স্পেস সংকুচিত হওয়া, বিরোধী দলকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করার অভিযোগ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে।
দেশ এখন আরেকটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগের দুটি খারাপ নির্বাচনের কলঙ্ক মুছে ফেলে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনা, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন এখন সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
র্যাবের প্রতিষ্ঠা, অপারেশন ক্লিনহার্ট এবং ক্রসফায়ারের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ধারণা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বিএনপি সরকারের আমলে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রসফায়ার তথা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
শুরুতে ক্রসফায়ার দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকি নিয়েও শেখ হাসিনা ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্যি বিএনপি প্রবর্তিত ক্রসফায়ারের ধারাটি বহাল থাকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও। ক্রসফায়ারের সাথে যুক্ত হয় গুম সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক অর্জন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ম্লান হয়ে যায় মানবাধিকার প্রশ্নে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, মাদক ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাহসী অভিযানে র্যাব যেমন প্রশংসা পেয়েছে; তেমন মানবাধিকার প্রশ্নে তাদের সমালোচনাও কম নয়। বিশেষ করে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয় বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তবে এটা ঠিক, ক্রসফায়ারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর মানবাধিকার পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। এই পরিস্থিতি ধরে রাখা এখন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
৭৩ বছরে আওয়ামী লীগ দেশকে দিয়েছে অনেক। কিন্তু দেশকে আরও এগিয়ে নিতে দরকার আওয়ামী লীগের বৃহত্তর চেষ্টা। শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের অন্য স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু পরিসংখ্যানের উন্নতিতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার অবকাশ নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে বের করে আনার কৃতিত্ব যার, সেই শেখ হাসিনার আমলে যেন আর একজন মানুষও ক্রসফায়ারের নিহত না হয়, আর কোনো সন্তানকে যেন গুম হওয়া বাবার ফিরে আসার আশায় কেঁদে দিন কাটাতে না হয়।
তবে আমার বিবেচনায় আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িকতার উত্থান। বাংলাদেশে দুটি ধারার রাজনীতি চলমান। সাম্প্রদায়িক ধারার নেতৃত্ব দেয় বিএনপি। আর অসাম্প্রদায়িক ধারার নেতৃত্ব বরাবরই আওয়ামী লীগের কাঁধে। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ ফিরে যায় পাকিস্তানি ভাবধারায়। বারবার কাটাছেঁড়া করে সংবিধানের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে বাংলাদেশকে আবার সঠিক লাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম শুরু করেন। সংবিধানে ফিরিয়ে আনা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু এরশাদের করে যাওয়া রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা যায়নি।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় সব দলই রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার এতটাই শিকড়ে পৌঁছেছে, আওয়ামী লীগও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার সাহস দেখাতে পারেনি। প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬ বছরের মাথায় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ তার নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে ফেলতে পারলেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে পারেনি।
সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স হলেও সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে ততটা সাহসী নয়। বরং সরকারের উৎখাতের ষড়যন্ত্র নিয়ে মতিঝিলে আসন গেড়ে বসা হেফাজতে ইসলাম এখন সরকারের পোষা। হেফাজতের দাবি মেনে বদলানো হয়েছে পাঠ্যপুস্তক।
সুযোগ পেলেই সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বারবার তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করেছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছে। এখন সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, একাত্তরের চেতনায় বাংলাদেশকে আবার অসাম্প্রদায়িক ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া।
৭৩ বছরে আওয়ামী লীগ দেশকে দিয়েছে অনেক। কিন্তু দেশকে আরও এগিয়ে নিতে দরকার আওয়ামী লীগের বৃহত্তর চেষ্টা। শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের অন্য স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু পরিসংখ্যানের উন্নতিতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার অবকাশ নেই।
এখন হতে হবে মানবিক উন্নয়ন, বৈষম্যহীন এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা। আর এটা করতে হলে আওয়ামী লীগকে হতে হবে পরিচ্ছন্ন, দুর্নীতিমুক্ত, আগের মতো সাহসী এবং অকুতোভয়।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ