ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঢাকায় হলেও তা ছড়িয়ে যায় জেলা, উপজেলা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে। বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক গড়ে ওঠে আন্দোলন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, চাটমোহর থেকে মেহেরপুর সবজায়গায় ভাষার আন্দোলনে জেগে ওঠে জনতা। যাদের নেতৃত্বে ভাষার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক।

মহান ভাষা আন্দোলনের আজ উনসত্তর পূর্ণ করে সত্তর এ প্রবেশ করেছে। সেই আন্দোলনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, আমরা বাংলাকে কতটুকু আপন করে নিতে পেরেছি। বাংলাকে আরও সমৃদ্ধ করতে কি দরকার? এমনই নানা প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্ট’র সঙ্গে কথা বলেছেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্ট’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু খালিদ

ঢাকা পোস্ট: মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত কেমন ছিল?

আহমদ রফিক: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বিকশিত রূপ হলো ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হওয়া। পরে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। সারাদেশে প্রতিবাদ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের সূচনা হয় ঢাকা শহরে, কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত।

ভাষা আন্দোলন আমাদের দুটি বিষয় উপহার দিয়েছিল একটি হলো পুলিশের গুলিতে ২১ ফেব্রুয়ারি শাহাদত বরণের কারণে দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে পরিচিতি। দ্বিতীয়ত, পরদিন ঢাকায় আমরা রাজপথে নামি এবং মিছিলে মিছিলে যে নতুন স্লোগান তৈরি হয়, সেখানে বলা হয় শহীদ স্মৃতি অমর হোক। এই শহীদ স্মৃতি অমর করতে গিয়ে আমাদের মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে হোস্টেলের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ১০ ফুট উঁচু, ৬ ফুট চওড়া একটি পাকা শহীদ মিনার তৈরি করে। এই শহীদ মিনার শুধু ঢাকা শহরেই হয়নি, সারাদেশের স্কুল কলেজে প্রাঙ্গণগুলোতেই গড়ে তোলা হয়। এ শহীদ মিনারের স্থায়ী রূপ বর্তমানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে রয়েছে। এ শহীদ মিনারটি জাতীয় জীবনের বড় একটি প্রতীক।

এর ফলে একদিকে শোক, আরেকদিকে প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়বাদের চেতনার মাধ্যমে ষাটের দশকের ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা, ভাসানীর ১৪ দফা— এগুলো মিলে সত্তরের গণজাগরণ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়।

ঢাকা পোস্ট: ভাষা আন্দোলন ছিল স্লোগানমুখর। তা পরে কতটুকু গুরুত্ব পায়?

আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলনের তিনটি স্লোগান ছিল। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’; ‘রাজতন্ত্রের জন্যে অর্থ চাই’; ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’। এ তিনটা স্লোগানের ওপর ভিত্তি করে দেশের ছাত্র, যুব সমাজ লড়াইয়ের মধ্যে তা অর্জন করে ।

ঢাকা পোস্ট: একুশের আন্দোলনের ফলে আমরা কী পেয়েছি?

আহমদ রফিক: আমরা পেলাম একটি নতুন পতাকা ও মানচিত্র। আমাদের স্বাধীন দেশে প্রত্যাশা ছিল একটি সংবিধানের, সেই সংবিধানে বলা হলো যে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এইটা অর্জিত হয়েছে একুশের আন্দোলনের ফলে।

ঢাকা পোস্ট: রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে আমরা কতটুকু নিজেদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি?

আহমদ রফিক: রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয় তাহলে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং উচ্চ আদালতসহ জাতীয় জীবনের সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রচলন হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে এটার সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে।

মাধ্যমিক ও দ্বাদশ শ্রেণি আর সচিবালয়ে ইংরেজির সঙ্গে বাংলার ব্যবহার, এ অর্জনের মধ্যেই আমাদের একুশের এত বড় আন্দোলনের অর্জন সীমাবদ্ধ থেকে গেল। এই যে এত বড় একটি স্লোগান সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষা চালু কর, এটা আর কেউ হিসাবের মধ্যে আনলো না।

রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয় তাহলে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং উচ্চ আদালতসহ জাতীয় জীবনের সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রচলন হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে এটার সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে।

ঢাকা পোস্ট: কী কারণে বাংলাকে আমরা সর্বস্তরের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি বলে আপনি মনে করেন?

আহমদ রফিক: পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে বিশেষ শ্রেণির প্রয়োজনীয় সব কিছুই পাওয়া হয়ে গেল। রাষ্ট্র থেকে সমাজ সবখানেই তারা তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে নিল। ফলে তারা রাষ্ট্র ভাষা বাংলা সর্বস্তরে চালু করার প্রয়োজনবোধ করলেন না।

ঢাকা পোস্ট: ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্যে কী করা উচিত ছিল বলে আপনি মনে করেন?

আহমদ রফিক: ১৬ খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের যেমন দলিলপত্র প্রকাশিত হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়েও তেমনি দলিলপত্র প্রকাশ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। রাষ্ট্রভাষাকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এ বিষয়টিকে আমরা গর্ব ও অহংকারের সঙ্গে গ্রহণ করেছি। কিন্তু জাতীয় জীবনের যে ঘটনা সেটাকে আমরা সরিয়ে রেখেছি। ঔপনিবেশিক রাজকীয় ভাষা ইংরেজি আগে যেমন ছিল সে অবস্থানেই থেকে গেল। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালত থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার বদলে ইংরেজি ব্যবহার চালু রইলো। বাংলা ক্রমে অবহেলিত হয়ে পড়লো এবং পিছু হটলো। বাংলা শিক্ষা এবং বাংলা ভাষা নির্ভুলভাবে বলা লেখা এবং চর্চার দিকটাতে একটা উদাসীনতা ও অবহেলা থেকেই গেল।

ঢাকা পোস্ট: আপনাদের আন্দোলন কী তবে বিফল হলো?

আহমদ রফিক: আমরা চেয়েছিলাম উর্দু এবং বাংলা দুটোই রাষ্ট্রভাষা হোক। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্ব ক্ষেত্রে, জাতীয় জীবনের সব জায়গায় বাংলার প্রচলন বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু স্বার্থবাদী শ্রেণির কারণে এই কাজটি হয় নি। যে শ্রেণি এই যুদ্ধটা চালালো তাদের যে প্রাপ্য সেটা পূর্ণ হওয়ার কারণে সর্বস্তরের বাংলা প্রচলনে যে পরিমাণ পরিশ্রম করার প্রয়োজন হয় তা করতে তারা রাজি হলো না। কাজেই ওইদিন দ্বিতীয় স্লোগানটি অ-অর্জন রয়ে-ই গেল, বাস্তবায়িত হল না। এটা আমাদের জন্যে গভীর হতাশা এবং বেদনার কারণ।

সত্তর বছর পরে ভাষাসৈনিকদের তালিকা করা সম্ভব নয়। আজ সত্তর বছর পরে কোথায় পাবেন আপনি দলিল পত্র। কাজেই এখন তালিকা করতে গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথ্য পাওয়া যাবে না। আমার জানা মতে, আমার সমবয়সী এমনকি ছোটরাও প্রায় সবাই প্রয়াত। তাহলে আপনি কার কাছে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন। তথ্য উপাত্ত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ঢাকা পোস্ট: এক্ষেত্রে তরুণদের কী কিছু করার আছে বলে মনে করেন?

আহমদ রফিক: তরুণ সমাজ, নতুন প্রজন্ম যদি মনে করে, আমাদের জাতি রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা, সেই হিসাবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা জীবিকার ভাষা হওয়া উচিত, আমাদের উচ্চশিক্ষা, উচ্চ আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা হওয়া উচিত, তা নিয়ে আন্দোলন করা উচিত তাহলে তারা আন্দোলন করবে। তারা যদি আন্দোলনে এগিয়ে আসে তাহলেই সম্ভব, নইলে তা সম্ভব নয়।

অতীতের তরুণ প্রজন্ম সংগ্রাম করে স্বাধীন ভাষা অর্জন করেছে। এখন বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যদি সচেতন হয়, জাতি রাষ্ট্র কাকে বলে এই বিষয়টা যদি বুঝে জীবিকার ভাষা মনে করে বাংলাকে এবং জাতীয় জীবনের সর্বস্তরের ভাষা এই বোধে যদি তারা সক্রিয় হয় তাহলেই একমাত্র তা কার্যকর হবে।

ঢাকা পোস্ট: এত বছরেও ভাষাসৈনিকদের তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয় নি, কেন?

আহমদ রফিক: সত্তর বছর পরে ভাষাসৈনিকদের তালিকা করা সম্ভব নয়। আজ সত্তর বছর পরে কোথায় পাবেন আপনি দলিল পত্র। কাজেই এখন তালিকা করতে গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথ্য পাওয়া যাবে না। আমার জানা মতে, আমার সমবয়সী এমনকি ছোটরাও প্রায় সবাই প্রয়াত। তাহলে আপনি কার কাছে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন। তথ্য উপাত্ত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর দলিলপত্র পাওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার। এটা আগেই হওয়া উচিত ছিল, যখন সাক্ষ্য প্রমাণগুলো জলজ্যান্ত ছিল। তখনই করা উচিত ছিল। যারা বলতে পারতো যে কে কে আন্দোলন করেছে, কারাগারে গেছে ইত্যাদি। এখন বলার মতো কেউ নেই।

ঢাকা পোস্ট: ভাষা আন্দোলনের চেতনা কতটুকু আমরা ধরে রাখতে পেরেছি বলে আপনি মনে করেন?

আহমদ রফিক: আমরা চেতনাকে ধরে রাখতে পারি নাই। আমাদের অর্জন শুধুমাত্র একটি শহীদ দিবস, একটি শহীদ মিনার, একটি সংবিধান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা বাংলা পেয়েছি।

ইউরোপ বা যেকোনো জাতির রাষ্ট্রভাষা হল জীবিকার ভাষা। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরের ভাষা বাংলাকে আমরা জীবিকার ভাষা হিসেবে গড়ে তুলতে পারি নাই। আমাদের জীবিকার ভাষা ইংরেজি, উচ্চশিক্ষার ভাষা ইংরেজি, আমাদের উচ্চ আদালতের ভাষা ইংরেজি। কাজেই ভাষা আন্দোলনের সেই দাবিগুলো কি কোথাও অর্জিত হয়েছে? হয় নি।

ঢাকা পোস্ট: কী হওয়া উচিত ছিল? কেন হলো না?

আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলন নিয়ে যাদের যা করার দরকার ছিল তারা কেউ কিছু করে নি। এই এক কথাতে সব শেষ হয়ে যায়।

ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে দলিল করা উচিত ছিল। স্লোগানগুলোকে অবশ্যই বাস্তবায়ন করা দরকার। এমনকি হামিদুর রহমানের নকশায় ভাস্কর্যটি করা যেত, মূল শহীদ মিনার দৃষ্টিনন্দিত শহীদ মিনার হতে পারতো কিন্তু শহীদ মিনারকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। সেটার পুনর্নির্মাণ করতে পারতেন। তারা তো এগুলোর প্রয়োজনই মনে করছেন না।

সদিচ্ছার অভাব প্রচুর, বাংলার প্রতি অবহেলা। যেহেতু ইংরেজির ওপর দিয়ে সব চলছে, চলুক। এই মনোভাব নিয়ে চলা। সরকার থেকে, সমাজ থেকে এইটা যতদিন দূর না হবে আমাদের অঙ্গন থেকে ততদিন এই ভাষা আন্দোলনের মূল দাবিগুলো অনর্জিত থেকে যাবে।

ঢাকা পোস্ট: গণমাধ্যম কতুটুক তার জায়গা থেকে ভূমিকা রাখতে পারছে?

আহমদ রফিক: গণমাধ্যম তো বাংলা, ইংরেজি দুইটা ব্যবহার করছে। ইংরেজি-বাংলা দুটি মিশিয়ে চলছে। সমস্ত জাতি যেভাবে চলছে সে সেইভাবে তারাও চলছে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করতে গেলে তরুণ সমাজ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ অর্থাৎ ভাষা সচেতন, রাষ্ট্র সচেতন মানুষ সহ গণমাধ্যমগুলো যদি এগিয়ে না আসে, তাদের আচার আচরণে যদি বাংলাকে প্রাধান্য দেওয়া না হয় তাহলে যা ঘটছে এখন এটাই ঘটতে থাকবে। বাংলা অবহেলিত অবস্থায় দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

ঢাকা পোস্ট: তাহলে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা, এ কথা শুধু বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

আহমদ রফিক: হ্যাঁ তাই। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে বাংলাদেশকে আধা রাষ্ট্র বলা উচিত, এর বেশি নয়। কারণ বাংলাদেশে মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে পরিণত হয়েছে, এটুকুই। কিন্তু জাতীয় ভাষা এবং জীবিকার ভাষা হিসেবে এর কোনো ব্যবহার নেই। কাজেই সে হিসেবে জাতি রাষ্ট্র হিসেবে যে সংজ্ঞা সেই সংজ্ঞায় বাংলাদেশ এখন পরিপূর্ণভাবে জাতীয় রাষ্ট্র নয়। ইউরোপের দিকে তাকালে যেমন দেখবেন আমাদের এখানে তা নেই। হয় নি।

ঢাকা পোস্ট: আপনাকে ধন্যবাদ।

আহমদ রফিক: আপনাকেও ধন্যবাদ।

একে/বিডি