বাজেটে কর্মসংস্থানের সংস্থান কতটুকু!
‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ স্লোগান নিয়ে ৯ জুন ২০২২ মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। দেশের বিভিন্ন ব্যয় নির্বাহের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায় দেশের ৫১তম বাজেট উপস্থাপন করেন, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি।
বাজেটে আগামী অর্থবছরের সরকারের আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা এবং স্বাভাবিক কারণেই বাজেট ঘাটতির আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায় যা বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে ঘাটতি দাঁড়ায় (-)৫.৪০ শতাংশ।
বিজ্ঞাপন
প্রস্তাবিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায় মূল্যস্ফীতির আস্ফালন নিয়ন্ত্রণ রেখে বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেই যে এই বাজেটের মুখ্য উদ্দেশ্য তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
তবে, মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্বের তীব্রতা কমিয়ে জনজীবনে স্বস্তি ফেরানোই এই বাজেটের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা বলে মনে হচ্ছে! অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের অর্থনীতি কোথায় আছে এবং কোন পথে যাচ্ছে, তা জানতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের সূচক দেখতে হয়।
আমাদের দেশের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল ২০১৬ সালে এবং ঐ জরিপ অনুযায়ী মোট শ্রমশক্তির মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ যার মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ এবং বাকি ২৭ লাখ বেকার। ২০১৬ সালের পর আর কোনো জরিপ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের সমসাময়িক চিত্র পেতে হলে আমাদেরকে বিদেশি সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করতে হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থানের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ ২০২২ সালে বেকার থাকবে যা মহামারি-পূর্ব সময়ের তুলনায় অন্তত ৫ লাখ বেশি। এছাড়া, দেশে বেকারত্বের হার ২০২২ সালে বেড়ে ৫ শতাংশে দাঁড়াবে, যা মহামারি-পূর্ব সময়ের চেয়ে ০.৬ শতাংশের বেশি।
দেশের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল ২০১৬ সালে এবং ঐ জরিপ অনুযায়ী মোট শ্রমশক্তির মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ যার মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ এবং বাকি ২৭ লাখ বেকার।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এই হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি এবং প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবিকার সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
বাজেটে কর্মসংস্থানের গুরুত্ব বিবেচনা প্রসূত সাংবাদিকদের সাথে প্রাক-বাজেট আলোচনাতেও ৮ জুন ২০২২ (বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত) মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের কেন্দ্রবিন্দু হবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
৯ জুন ২০২২ জাতীয় সংসদে বাজেটে ২০২২-২০২৩ উপস্থাপনে মাননীয় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দেশের সব অংশে কর্মসংস্থানের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে সরকার ১০০টির বিশেষ অর্থনৈতিক জোন স্থাপন করছে, যেখানে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়িত হওয়ায় দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিং পেশায় যুক্ত আছেন।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, সরকার ২০২৫ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ‘রূপকল্প-২০৪১’ ও এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপের মাধ্যমে ৮৭ হাজার ২৩০টি গ্রামের উন্নয়নের জন্য রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে বলেও তিনি বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেন।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় কর্মসংস্থানের ব্যাপারে যেসব বিষয় উল্লেখ করেছেন তা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে, বাজেটে উল্লেখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আর্থিক বরাদ্দের প্রস্তাব না থাকায় এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে!
তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উপজেলা পর্যায়ে ১০০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ আরম্ভ করা হবে। এছাড়া ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৮ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার এবং ৫ লাখ ২০ হাজার জনকে বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় কর্মসংস্থানের ব্যাপারে যেসব বিষয় উল্লেখ করেছেন তা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে, বাজেটে উল্লেখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আর্থিক বরাদ্দের প্রস্তাব না থাকায় এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে! কেননা, দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে অবশ্যই কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং তার জন্য দরকার অতিরিক্ত উন্নয়ন কার্যক্রম।
আগামী প্রস্তাবিত বাজেটের উন্নয়ন কার্যক্রমের অধীনে মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৯৩,৪৬৪ কোটি টাকা যা এই বছরের তুলনায় মাত্র ১৬,১৯৩ কোটি টাকা বেশি (মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় ব্যতীত)।
গ্রামের উন্নয়নের কথা বলা হলেও স্থানীয় সরকার ও গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫,৮৪৬ কোটি টাকা যা বর্তমান বাজেটের তুলনায় ১,৯৪৮ কোটি টাকা বেশি।
তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ নির্ভর কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও এই খাতে উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২,৯১৬ কোটি টাকা যা গত বছরের তুলনায় মাত্র ১৯৬ কোটি টাকা বেশি।
দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও কর্মের দক্ষতা বৃদ্ধিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উন্নয়ন ব্যয়ে এই বছরের তুলনায় আগামী বছরে বরাদ্দের পরিমাণ ২৮৮ কোটি টাকা বাড়লেও শ্রম ও কর্মসংস্থান এই বছরের তুলনায় আগামী বছরে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ২৮ কোটি টাকা।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরকে অবশ্যই প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে হবে এবং সেই কারণেই আমাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি খাতে বাজেট পরিমাণ বাড়াতে হবে।
আমাদের প্রবৃদ্ধি যেটুকু বেড়েছে সেই হারে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়েনি। তাই, বিশাল বেকার কর্মীর জন্য যৌক্তিকভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা গেলে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে।
আগামী বছর এই খাতে (সকল উপখাত মিলে) বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯৯,৯৭৮ কোটি টাকা যা এই বছরের তুলনায় ৫,১০০ কোটি টাকা বেশি মনে হলেও বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদার তুলনায় খুবই কম। নতুন অর্থবছরের আসন্ন বাজেটে অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) জন্যও বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে ১০-১২ শতাংশ কর্মসংস্থান আনুষ্ঠানিক খাতে এবং বাকি ৮৮-৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান অনানুষ্ঠানিক খাতের। তাই আমাদের সরকারকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতের প্রতি অতিরিক্ত জোর দিতে হবে।
ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যয় সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ও টার্নওভার করের হার ০.৬০ শতাংশের পরিবর্তে ০.১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার বর্তমানে ২২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।
আবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির কর হার বর্তমানে ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে এবং একক ব্যক্তির কোম্পানির কর হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ অবশ্যই ব্যক্তি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি ২০২০ (খসড়া) এর প্রাক্কলন অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ২৬ লাখ লোক নতুন করে শ্রমের বাজারে প্রবেশ করে। তাছাড়া, করোনা মহামারির কারণে আগের কর্মসংস্থান যেমন অনেকে ধরে রাখতে পারেনি, তেমনি ২০২০ ও ২০২১ সালে চলমান করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, ইত্যাদি কারণে বেসরকারি খাতে নতুন কোনো কর্মসংস্থান হয়নি বললেই চলে।
আমাদের প্রবৃদ্ধি যেটুকু বেড়েছে সেই হারে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়েনি। তাই, বিশাল বেকার কর্মীর জন্য যৌক্তিকভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা গেলে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে। আর, কর্মসংস্থানের জন্য দরকার এক বিশাল কর্মযজ্ঞের যার আয়োজনে আমাদের সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে।
আর্থিক বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আরও ব্যয় বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের বরাদ্দ কমিয়ে, উৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অধিকন্তু, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে যে অর্থই বরাদ্দ থাকুক না কেন, তা যাতে স্বচ্ছতার মাধ্যমে ও দক্ষতার সাথে নির্ধারিত সময়ে ব্যয় হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়