বাজেট ২০২২-২৩ : কতটা জনবান্ধব?
সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই বছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবিত হয়েছে বিভিন্ন মুখী চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে। সার্বিকভাবে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার সংকট ঐতিহাসিকভাবে আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে আসছে।
এর সাথে করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বাজেট বরাদ্দ ও এর বাস্তবায়নকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা উত্তর সরবরাহ ব্যবস্থার শ্লথগতি বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভিন্নমাত্রার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সর্বোপরি, বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাজারে মূল্যস্ফীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতির সাম্প্রতিক সংকট এ বছরের বাজেট প্রণয়নকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিজ্ঞাপন
আর এসব চ্যালেঞ্জের ফলে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষ। ৯ জুন ২০২২ প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটকে ঘিরে তাই অনেক প্রত্যাশা ছিল যার কিছুটা পূরণ হলেও সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় সাধারণ মানুষের চাহিদার অনেকটাই প্রতিফলিত হয়নি।
সন্দেহ নেই যে, বর্তমান প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ সবচাইতে উৎকণ্ঠিত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে স্বস্তি দিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর ও শুল্ক ছাড় (বিশেষত আমদানি শুল্ক ও রেগুলেটরি ডিউটি), নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের থেকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে মূসক ছাড় ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—যা পণ্যের দামের ক্ষেত্রে সাশ্রয় করতে সাহায্য করবে।
প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশা ছিল যার কিছুটা পূরণ হলেও সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় সাধারণ মানুষের চাহিদার অনেকটাই প্রতিফলিত হয়নি।
কৃষি যন্ত্রাংশের ওপর মূসক ও অগ্রিম কর ছাড়ের মতো সিদ্ধান্তগুলো কৃষি পণ্য উৎপাদনের খরচ কমাতে পারে। এছাড়া কৃষি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে বড় আকারের ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে যা মূল্যস্ফীতিতে রাশ টানতে সহায়ক হবে। তবে ৮২,০০০ কোটি টাকার ভর্তুকির প্রেক্ষিতে জ্বালানিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দাম সাধারণ মানুষের জন্য কেমন হবে তা সুস্পষ্ট না।
এছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দাম সমন্বয় করতে ভবিষ্যতে দাম বাড়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। এর পাশাপাশি দেশীয় বাজারে চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের ব্যাখ্যার বাইরে যে মূল্যস্ফীতি তার রাশ টানা না গেলে সাধারণ মানুষের জন্য বিপত্তি বাড়বে।
অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার যে প্রস্তাবনা বাজেটে দিয়েছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কীভাবে তা সম্ভব হবে তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের গবেষণায় দেখা গেছে যে, সমাজের একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য, মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্য-মূল্যস্ফীতির চাপ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্বিক মূল্যস্ফীতির হিসাবের তুলনায় অনেক বেশি। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ওএমএস-এর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বল্পমূল্যে যে খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এই উপখাতে বরাদ্দ কমার প্রস্তাবনা রয়েছে (১৯৪৩.৫৮ কোটি টাকা ছিল সংশোধিত বাজেট ২০২১-২২, যা বাজেট ২০২২-২৩ সালে কমিয়ে করা হয়েছে ১৭২০.১৩ কোটি টাকা), যেটি মূল্যস্ফীতির এই প্রেক্ষাপটে নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য সুখকর খবর নয়। এছাড়া এর আওতায় মধ্যবিত্তরা কিন্তু বাদ পড়েই যাচ্ছেন—বস্তুত পক্ষে মধ্যবিত্তদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য অনুরূপ কিছু কর্মসূচি বা বরাদ্দ এই বাজেটে থাকা জরুরি ছিল।
তৃণমূলের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পেনশন বাদে বরাদ্দ ২০২২-২৩ বাজেটের ১২.৬ শতাংশ, যা সংশোধিত ২০২১-২২ বাজেটে ছিল ১৪.৯ শতাংশ—করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জিং প্রেক্ষাপটে এই খাত থেকে দরিদ্র মানুষের প্রত্যাশা তাই সেভাবে মেটেনি।
এছাড়া জিডিপির সাপেক্ষে বিবেচনায় এখাতের বাজেট কমেছে। এছাড়া সামাজিক অবকাঠামো যেমন শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বছরগুলোর ধারাবাহিকতাই বজায় রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান তৈরি, কিংবা কর ব্যবস্থাপনায় সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা দেখতে পাচ্ছি না।
বস্তুত সামাজিক অবকাঠামোর বিভিন্ন খাতগুলোর বরাদ্দ সবসময়ই সাধারণ মানুষের সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করে, তাই এখাতগুলো নিয়ে প্রত্যাশাও থাকে অনেক। বাজেটে সর্বজনীন পেনশনের ঘোষণা অবশ্য এই প্রেক্ষিতে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং এর সঠিক প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনা দীর্ঘমেয়াদে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
বাজেটকে ঘিরে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্তের প্রত্যাশার জায়গা করমুক্ত আয়ের সীমা—২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে এই সীমা বার্ষিক ৩ লাখ টাকা (নারী, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ৩.৫ লাখ টাকা) থেকে বাড়ানো হয়নি।
মূল্যস্ফীতি ও করোনা পরবর্তী সময়ের বিচারে এই আয় সীমা বাড়ানো হলে মধ্যবিত্ত উপকৃত হতেন, তাই হতাশ হয়েছেন তারা। তবে অনেক অর্থনীতিবিদ আবার মনে করেন যে, জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির বিচারে করমুক্ত আয় সীমা পরিবর্তন না করে বরং কর-স্ল্যাবের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে কর-হার বৃদ্ধি করা ও সমন্বয় সাধন করা যেতে পারত-যা আয় বৈষম্য কমাতে সহায়ক হতে পারত।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, কর্পোরেট কর-হার কমানোর সিদ্ধান্ত—প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে শিল্পায়নের সহায়ক হলেও এই সিদ্ধান্তের সুফল সাধারণ জনগোষ্ঠী কতটা পাবে তা বলা কঠিন, কারণ শ্রম ঘন শিল্পে প্রবৃদ্ধি না হলে কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হবে না।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে, প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান তৈরি, কিংবা কর ব্যবস্থাপনায় সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা দেখতে পাচ্ছি না।
সন্দেহ নেই যে, সামষ্টিক অর্থনীতির সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির চাপ, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এসব কিছুর প্রেক্ষিতে বাজেট প্রণয়নে সরকারের কাছে খুব বেশি বিকল্প ছিল না।
তাই সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা ও মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে জাতীয় আয়ের প্রেক্ষিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, আয় বৈষম্য কমাতে প্রগ্রেসিভ কর কাঠামো (বিশেষ করে আয়করের ক্ষেত্রে সংস্কার, সম্পদ কর ইত্যাদির ক্ষেত্রে পরিবর্ধন), পরিচলন ব্যয়ে কাটছাঁট, ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হলে এর মাধ্যমে বাজেটের সুফল সাধারণ মানুষের পক্ষে পাওয়া সম্ভব।
অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা ।। অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়