কেমন শিক্ষা বাজেট চাই
‘শিক্ষা হলো সবচেয়ে ক্ষমতাধর অস্ত্র যা আমরা ব্যবহার করতে পারি এই পৃথিবীকে পালটে ফেলতে।’ নেলসন ম্যান্ডেলার এই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় জীবন উন্নয়নের প্রধান সোপান হলো শিক্ষা। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এই কথা নতুন করে বলার আর কিছু নেই।
যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সেই জাতি তত বেশি সভ্য ও উন্নত। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করার কথা কল্পনাই করতে পারে না। বাংলাদেশকে বিশ্বের রোল মডেল এবং সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে আমার সোনার মানুষ চাই। নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করে প্রতিটি মানুষকে শিক্ষিত করতে না পারলে সোনার মানুষ গড়া যাবে না।’
বিজ্ঞাপন
এছাড়াও শিক্ষাকে তিনি দেখেছেন ভবিষ্যতের জন্য শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ হিসেবে। তিনি বলেছিলেন, আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।
আমাদের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব বাঙালি জাতির মহান নেতার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে শিক্ষা বাজেটে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও জিডিপিসহ সার্বিক হিসেবে তা কমেছে। করোনা মহামারি-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করতে এই বাজেট যথেষ্ট নয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যেসব খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষাখাত।
১৯৭২ সালে মোট বাজেটের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের হিস্যা ছিল ২২ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিতে চেয়েছিলেন। তার সময়ে তৈরি কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন তাদের রিপোর্টে বলেছিল, শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ৫-৭ শতাংশ দরকার।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। বঙ্গবন্ধুর হাতে পরিণত হওয়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। কিন্তু শিক্ষাখাতে জিডিপির ২ দশমিক ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গত অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে টাকার অংকে ১৩ হাজার কোটি টাকা অধিক বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলেও তা মোট বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি নয় এবং এটি জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৮ ভাগ।
চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২১-২০২২ অর্থবছরে শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ ভাগ। চলতি অর্থবছরের তুলনায় টাকার অঙ্কে শিক্ষাখাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির হিসাবে তা চলতি বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ১ ভাগ কমতে পারে।
একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র্যাঙ্কিং করার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো দেখা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা কতটা শক্তিশালী।
পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশ থেকে যারা উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে বা হওয়ার পথে তাদের বেশিরভাগেরই শিক্ষাখাতের বরাদ্দ অনেক বেশি। মালয়েশিয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ছিল শিক্ষাখাতে, যার পরিমাণ ছিল ৫০ দশমিক ৪ বিলিয়ন মালয়েশিয়ান রুপি, যা সরকারি ব্যয়ের ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
নেপাল ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রেখেছে মোট বাজেটের ১১ শতাংশ, যা জিডিপির ৪ শতাংশ। ভুটান ২০২১-২২ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রেখেছে শিক্ষাখাতে যার পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন নেপালি রুপি, যা সরকারি ব্যয়ের ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া শিক্ষাখাতে ব্রাজিলে জিডিপির ৬ শতাংশ, আফ্রিকার দেশ ঘানায় জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। তবে বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে আনুপাতিক হিসেবে বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে কম।
বাংলাদেশের শিক্ষা ও প্রযুক্তিখাতে বরাদ্দের তুলনামূলক চিত্র:
অর্থবছর | মোট বরাদ্দ (কোটি টাকায়) | মোট বাজেটের শতাংশ | শিক্ষাখাতে জিডিপির ন্যূনতম শতাংশ |
২০২১-২০২২ |
৭১,৯৫১ |
১১.৯১ |
২.০৮ |
২০২০-২০২১ |
৬৬,৪০০ |
১১.৬৯ |
২.০৯ |
২০১৯-২০২০ |
৭৯,৪৮৬ |
১৫.২০ |
২.৭৫ |
২০১৮-২০১৯ |
৬৬,২৭৩ |
১৪.৯৭ |
২.৬১ |
করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছরের মতো শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির থাকায় বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের অবস্থা বেশ শোচনীয়। গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স-এর তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশ ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২তম অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন ও জিডিপির দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের উপরে থাকলেও জ্ঞান সূচকে আমরা তলানির দিকে অবস্থান করছি। জিডিপির ন্যূনতম একটি অংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রেখে কোনো দেশ উন্নত হয়েছে এমন নজির খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।
আপাতদৃষ্টিতে উন্নয়ন মনে হলেও দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কম থাকায় ভবিষ্যতে এর প্রভাব হবে ভয়ংকর। বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বাজেট কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বিশিষ্টজনদের অনেক পরামর্শ রয়েছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষাখাতের কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে নজর দিতে হবে তা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যেসব খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষাখাত।
বিশ্বের ১২৫টির মতো দেশে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটি খাত রয়েছে, যার বরাদ্দ শিক্ষাখাতের বরাদ্দের বাইরে রাখা হয়। সদস্য দেশগুলো এই খাতে প্রতি বছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করে থাকে। কিছু পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যারা বেশি ব্যয় করে, তারা তত বেশি উন্নত। সেই তালিকায় নেপালও আছে। কিন্তু এই তালিকায় নেই বাংলাদেশ।
এছাড়া একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র্যাঙ্কিং করার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো দেখা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা কতটা শক্তিশালী। তাই গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটি খাত তৈরি করে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সকল শিক্ষার্থীর হাতে ডিজিটাল যন্ত্রের অভাব ও দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ, যা বাংলাদেশের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। বর্তমান ও ভবিষ্যতে করোনার মতো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিক্ষাঙ্গনে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রযুক্তিগত অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা বাজেটে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত।
তাই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিগত সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে যেন ডিজিটাল যন্ত্র থাকে সেই বিষয় নিশ্চিত করতে নতুন শিক্ষা বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অসম অনুপাত লক্ষণীয়, যা সুষ্ঠু শিক্ষাদানে এক বড় বাধা। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যেখানে উন্নত দেশগুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১২/১৫, সেখানে বাংলাদেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩৫। এই নতুন শিক্ষা বাজেটে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের ব্যবধান কমানোর জন্য একটি যুগোপযোগী বরাদ্দ থাকা করা জরুরি।
সর্বোপরি, বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক বিদ্যমান থাকলেও করোনা মহামারির জন্য অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক কারণে মৌলিক শিক্ষা থেকেও ছিটকে গেছে। তবে, এসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা বিষয়ে বরাদ্দের স্পষ্ট কোনো দিক-নির্দেশনা নেই বর্তমান শিক্ষা বাজেটে।
ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে সুস্পষ্ট নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বাজেটে রাখা আশু প্রয়োজন। এছাড়া বর্তমান বাজেটে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’কে সামনে রেখে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কারণ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিল্পায়নের চতুর্থ স্তরে উন্নীত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা শিক্ষা পদ্ধতি চতুর্থ স্তরে উন্নীত করেছে।
তাই দেশকে শিল্পায়নের চতুর্থ স্তরে উন্নীত করতে প্রথম যে বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে তা হলো শিক্ষাব্যবস্থা। সুতরাং শিক্ষাকে চতুর্থ স্তরে উন্নীত করতে চাই পর্যাপ্ত শিক্ষা বাজেট।
উল্লিখিত বিষয়গুলো আসন্ন ২০২২-২০২৩ শিক্ষা বাজেটে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই শিক্ষাখাতে সর্বাধিক বরাদ্দ রেখেই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতে হবে, যা বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ পদক্ষেপ।
ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়