পদ্মা সেতুর উদ্বোধন : উৎসব হোক সবার
কবি গুরুর কাছ থেকে ধার নিয়ে বলি : ‘অন্ধকারে সিন্ধু তীরে একলাটি ওই মেয়ে
আলোর নৌকা ভাসিয়ে দিলো আকাশ পানে চেয়ে।’
পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনার নামে হলো না বলে যারা কিছুটা হতাশ তাদের বলি, নাম যাই হোক, পদ্মা সেতুর নাম নেওয়ার সাথে সাথে, এরসাথে অবধারিতভাবেই উচ্চারিত হবে শেখ হাসিনার নাম। যেমনটি বাংলাদেশের নামটির সাথে উচ্চারিত হয় শেখ মুজিবের নাম।
বিজ্ঞাপন
বার বার বলেছি, আবারও বলি, পদ্মা সেতু ইট, ইস্পাত, লোহা আর কংক্রিটের একটি অবকাঠামো মাত্র নয়। এটি একটি সেতু মাত্র নয়। এটি বাংলাদেশের মর্যাদার একটি প্রতীক।
একটি সংসারের অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে সেই পরিবারের সদস্যদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একজন অভিভাবক তার পরিবারের সদস্যদের জন্য এই সব বিষয় নিশ্চিত করলেন, কিন্তু পরিবারের মর্যাদা রক্ষা করতে পারলেন না, তাকে আর যাই হোক সফল অভিভাবক বলা যাবে না।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেই সফল অভিভাবক, যিনি বাংলাদেশের মর্যাদা আকাশ সমান উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। যখন বিশ্বের ক্ষমতাবানরা পদ্মাসেতুর নামে দুর্নীতি হচ্ছে বলে বাংলাদেশের মর্যাদা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল, তখন শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের তর্জনী আবার শেখ হাসিনার তর্জনীতে ভর করে রুখে দিয়েছিল সেই উদ্যত কালোহাত। সেই তর্জনীর দেখানো পথেই শেখ হাসিনা গড়লেন পদ্মা সেতু।
কাজেই সেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী দিন, ২৫ জুন,২০২২ শুধুমাত্র একটি দিনের উৎসবে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না । এই সেতু উদ্বোধনের উৎসব হবে আগে ও পরে লাগাতার জনতার উৎসব। এই উৎসব উদযাপনে দল ও সরকার নিশ্চয়ই নিজের পরিকল্পনায় অগ্রসর হবে।
কিন্তু দেশের সকল স্তরের মানুষ নিজস্ব পরিকল্পনায় যুক্ত হোক এই উৎসবে। এই উৎসব পরিণত হোক জাতীয় উৎসবে। নিজস্ব ধারনা থেকে এই জনউৎসবের একটি খসড়া প্রস্তাবনা পেশ করছি। নিশ্চয়ই আরও অনেকের মতামতে তা আরও পূর্ণতা পাবে।
জনউৎসবের খসড়া প্রস্তাবনা
১. যে দিন পদ্মা সেতুতে আলো জ্বলবে সেদিন থেকেই শুরু হোক এই উৎসব ।
২. পদ্মা সেতু সরাসরি যে ২১টি জেলাকে যুক্ত করবে তার প্রতিটিতে প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে ২৫ জুন পর্যন্ত হবে আনন্দ মিছিল, পদযাত্রা, সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান। এতে অংশ নেবে এইসব এলাকার দলমত, সম্প্রদায় নির্বিশেষে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ব্যবসায়ী-পেশাজীবীসহ সকল বয়সী নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরের দল।
৩. প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেওয়া হোক বিশেষ দোয়া/প্রার্থনার কর্মসূচি।
৪. জনগণের কাছে বিতরণ করা হোক বুলেট পয়েন্টে পদ্মা সেতুর সকল তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা প্রচারপত্র। থাকুক ২০০ শব্দে লেখা নেপথ্য ইতিহাস।
৫. এই ২১ জেলার সাথে প্রতিদিনই যুক্ত হবে দেশের অন্য যে কোনো এলাকা । একই ধরনের কর্মসূচি পালন করতে পারেন তারাও। এতে জাতীয় উৎসবের আবহ তৈরি হবে।
৬. দেশের সকল বিশ্বিবিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে চলবে আনন্দ মিছিল, পদযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (আজ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় কাল হবে জাহাঙ্গীর নগরে)। এর আয়োজক হবে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষার্থীদের নানা ক্লাব। ছাত্রদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নেবে পৃথক কর্মসূচি।
৭. রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বা শিল্পকলা একাডেমিতে পালিত হোক মর্যাদার আনন্দসপ্তাহ। ২৫ জুনের আগে সপ্তাহজুড়ে পালিত হোক এই উৎসব। শিল্পকলা একাডেমি বা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নিতে পারে এই দায়িত্ব।
এই উৎসবের আবহ তৈরি করতে পারে এজন্য এখনই শুরু করা যায় এমন প্রস্তাব
১. উদ্বোধনের জন্য সেতু বিভাগ নিশ্চয়ই আমন্ত্রনপত্র পাঠাবে। আমার প্রস্তাব,
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিবন্ধন পাওয়া সকল রাজনৈতিক দলের প্রধানের কাছে পত্র পাঠাতে পারেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে। দলের দায়িত্বশীলদের একটা টিম এই সপ্তাহ থেকেই সকল দলের কাছে এই আমন্ত্রণপত্র হাতে হাতে পৌঁছে দিক। এই আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হোক দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের কাছেও। এমনকি ডক্টর ইউনুসকেও আমন্ত্রণ জানানো হোক। কাদের আমন্ত্রণ জানানো হলো তা সংবাদ মাধ্যমের খবর হোক প্রতিদিন।
২. এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য সংবাদপত্রে সাধারণত সরকারি খরচে ক্রোড়পত্র দেওয়া হয় যেটা কেউ পড়ে না। আমি বরং অন্যভাবে সংবাদ মাধ্যমকে সম্পৃক্ত করার পক্ষে। আমার প্রস্তাবনা : এখনই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সকল প্রধান সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সম্পাদকদের কাছে জানতে চাইতে পারেন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে তাদের বিশেষ পরিকল্পনা আছে কি না। এই বিশেষ পরিকল্পনার জন্য তারা যে তথ্য-উপাত্ত চান সেটা দ্রুত দিতে হবে। প্রয়োজনে সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক ও আলোকচিত্র সাংবাদিকদের প্রাক উদ্বোধনী সফরের আয়োজন করা যেতে পারে সেতু ও সেতু এলাকায়। যাতে যে কোনো বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত তথ্য তাদের হাতে থাকে।
৩.পদ্মা সেতুর আদ্যোপান্ত নিয়ে এখনই বাংলা ও ইংরেজিতে ঝরঝরে ভাষায় তৈরি হোক একটি ফ্যাক্টশিট। এটি এখন থেকেই প্রচারিত হোক দেশ জুড়ে।
৪. উদ্বোধনী দিনে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সমাবেশ হবে এটা বোঝা যাচ্ছে। আমার প্রস্তাবনা: উদ্বোধনের পর সেতুর যে কোনো প্রান্তেই হোক, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, আমন্ত্রিত রাজনৈতিক নেতা ও বিদেশি কূটনীতিক, বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকার প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচ মিনিট হেঁটে যাবেন। একটি ছবি তুলবেন; যা হবে ইতিহাসের প্রামাণ্য।
৫.সেতুতে আলো জ্বলার দিন থেকে যে উৎসবের শুরু হলো এই উৎসব চলবে উদ্বোধনের পরে এক সপ্তাহ ধরে। এই এক সপ্তাহ ধরে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে থাকবে নানা আয়োজন। সেতু ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের শুধু তথ্য ও সহযোগিতা দিয়ে বাধিত করবেন।
আজ থেকে শত বর্ষ পরে যে শিশুদল পার হবে এই পদ্মা সেতু, আসুন আমরা সবাই মিলে তাদের জন্য সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে দিয়ে লিখে রেখে যাই ইতিহাস,যে ইতিহাসের সারসংক্ষেপ হচ্ছে : শত চক্রান্ত আমাদের দাবায়া রাখতে পারে নাই। এক দৃঢ় প্রত্যয়ী রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্বে কারো কাছে মাথা নত না করে, সকল কূটকৌশল ছিন্ন করে আমরা গড়েছি মর্যাদার সেতু। এই সেতু আমাদের অনাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সাথে সেতুবন্ধের প্রতীকও।
আবারও বলি : দল ও সরকার তাদের আয়োজন করুক। আসুন আমরা নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যম মিলে আমাদের মর্যাদার পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে জাতীয় উৎসবে পরিণত করি। আমরাও ইতিহাসের অংশ হই।
মনজুরুল আহসান বুলবুল ।। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)
এনএফ