বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস
তামাক কেন ক্ষতিকারক?
৩১ মে বিশ্বজুড়ে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘তামাক পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ।’ আমাদের মনে রাখতে হবে, এখন সময় জীবন বাঁচাবার। বন্ধ করুন ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার। অর্থাৎ মানুষের জীবন বাঁচাতে হলে তামাকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
অনেকে দেখা যায়, মুখে গুল রাখেন। গুলের ব্যবহারে মুখে ক্যান্সার হয়। তামাকের ব্যবহারে হার্ট অ্যাটাক, করোনারি হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক হয়। ধূমপান ডায়াবেটিসেরও কারণ। যাদের সন্তান হচ্ছে না তাদেরও ধূমপান বন্ধ করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
যারা ধূমপানে অভ্যস্ত শুধু তারা ধূমপান থেকে বিরত থাকলেই হবে না; আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা এখনো ধূমপান করেনি এবং যারা ধূমপানে আসক্ত হওয়ার উপক্রম হতে পারে তাদেরকে রক্ষার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।
শিশু-কিশোরদের মাঝে ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে বড় স্কুল কলেজের শিক্ষকদের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দকে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। একই সঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপ্রিয় তারকাদেরও মাদকবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে হবে। তাদের একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন ধূমপান ও তামাক বিরোধী আন্দোলনে ডিজিটাল প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করেন।
পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তির বিধান জরিমানা আছে। এর প্রয়োগ হলে পাবলিক প্লেসে ধূমপান বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য হলেও তামাকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তামাক ও সিগারেট ব্যবহারে পরিবেশ নষ্ট হয়। সিগারেটের ফিল্টার মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। মাটির মতো পানিও সিগারেটের ফিল্টারে দূষিত হচ্ছে। ধূমপানের কারণে বায়ু দূষণ হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবস প্রচলিত হয়েছে। এছাড়াও দিবসের উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং স্বাস্থ্যের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানো যা বর্তমানে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিবেচিত এবং যার মধ্যে ধূমপানের পরোক্ষ ধোঁয়ার প্রভাবের কারণে প্রায় ৬ ছয় লক্ষ অধূমপায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে জোরালো করতে ১৯৮৭ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে বছরের একটি দিন বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসেবে উৎযাপন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথম বছর ১৯৮৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপিত হলেও একই বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ৩১ মে তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে সমস্ত পৃথিবীতে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে।
তামাকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে জনসচেতনতা বাড়াতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারিভাবে ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে এখনো জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয় না। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে তামাক বিরোধী জোট দেশব্যাপী জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস উদযাপন করে আসছে।
সারাদেশে বিগত বছরগুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, কর বৃদ্ধি, ধূমপানমুক্ত স্থান বৃদ্ধি, প্যাকেটের গায়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান, তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে সভা, সেমিনার, অবস্থান কর্মসূচি, র্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবস পালন করে আসছে।
তামাকের নিয়মিত ব্যবহারের ফলে মানব স্বাস্থ্যের উপর অনেক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। প্রাথমিকভাবে গবেষণা মূলত তামাকদ্রব্য ধূমপান বিষয়ের উপর করা হয়েছে।
১৯৫০ সালে Richard Doll নামক বিজ্ঞানী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে এটি গবেষণা প্রকাশ করেন যেখানে তিনি ধূমপান ও ফুসফুস ক্যান্সারের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। এর ঠিক চার বছর পর ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ ডক্টরস স্টাডি নামক আরেকটি গবেষণা প্রকাশ করেন যেটি চল্লিশ হাজার ডাক্তারের বিশ বছর ধরে করা গবেষণার ফলাফল। সেখানে ধূমপানের সাথে ফুসফুসের সম্পর্কের বিষয় নিশ্চিত করা হয় যার উপর ভিত্তি করে সরকার ঘোষণা করে যে, ধূমপানের ফলে ফুসফুসে ক্যান্সারের হার বৃদ্ধি পায়।
যেসমস্ত বস্তুর ব্যবহার বাদ দিলে অকাল মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস করা যায় তামাক এর মধ্যে শীর্ষে। যত লোক তামাক ব্যবহার করে তার প্রায় অর্ধেক এর ক্ষতিকর প্রভাবে মৃত্যুবরণ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় ৬০ লাখ লোক তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে মারা যায় (সর্বমোট মৃত্যুর প্রায় ১০%) যার প্রায় ৬ লাখ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বিংশ শতাব্দীতে তামাক প্রায় দশ কোটি ব্যক্তির মৃত্যু ঘটিয়েছে।
একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার কর ডিজিজ কন্ট্রোল এবং প্রিভেনশন (CDC) ও এটাকে সারা বিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তামাক মূলত হৃৎপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে।
ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) (অ্যামফাইসিমা ও ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসসহ) ও ক্যান্সার (বিশেষজ্ঞ ফুসফুস ক্যান্সার, প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার, ল্যারিংস ও মুখ গহ্বরের ক্যান্সার) এর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।
তামাক উচ্চ রক্তচাপ ও প্রান্তীয় রোগও সৃষ্টি করতে পারে। এর প্রভাব নির্ভর করে একজন ব্যক্তি দৈনিক কতটি ও কয় বছর ধরে ধূমপান করে তার উপর। অল্প বয়স থেকে এবং অধিক তামাকের ঘনত্ব সম্পন্ন সিগারেট খাওয়ার ফলে ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত তামাকজাত ধোঁয়া ও পরোক্ষ ধূমপান ও সকল বয়সী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
গর্ভবতী নারীদের উপর তামাকের ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। ধূমপায়ী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটার হার বেশি। এছাড়া গর্ভস্থ ভ্রূণেরও অনেক ক্ষতি করে। যেমন অকালের শিশুর জন্ম হওয়া (প্রিম্যাচুর বার্থ) জন্মের সময় নবজাতকের ওজন আদর্শ ওজনের তুলনায় কম হওয়া (LBW) ও সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিসনড্রোম (SIDS) এর হার ১.৪-৩% বেড়ে যায়। অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে যৌন সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার হার ৮৫% বেশি।
তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা জানি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান।
ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স প্রদান করে থাকে তাদের আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করে। বর্তমানে দেখা যায়, মুদি দোকান থেকে শুরু করে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে।
যখন একটি লাইসেন্স প্রদান করা হয়ে থাকে তখন সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে সেটা উল্লেখ করা থাকে। তাই মুদি দোকানের জন্য লাইসেন্স নিয়ে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারে না। এক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে আইনের লঙ্ঘন ঘটে। এই বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যদি তার আওতাধীন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করে যে, তারা যে লাইসেন্সগুলো প্রদান করেছে তা সঠিকভাবে তদারকির জন্য। তাহলে তামাকজাত দ্রব্য যত্রতত্র বিক্রয় অনেকাংশে কমে আসবে।
তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে ও বিপণনের জন্য বাংলাদেশে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এমনকি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্তদের নির্ধারিত কোনো ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের ব্যবস্থা নেই। যে কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রের আশেপাশের এলাকা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্নস্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তামাকজাত পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে।
সহজলভ্যতা ও সহজপ্রাপ্যতার কারণে যত্রতত্র তামাকজাত পণ্যের বিপণন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। উৎকণ্ঠার বিষয় এই ধরনের দোকানের সংখ্যা দিন দিন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এর বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রণয়ন করে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
কিছু কিছু দেশ তামাকের ব্যবহার ও বিক্রয় কমানোর জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। এছাড়া তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সতর্কীকরণ বার্তা লেখার নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অধিকন্তু তামাকের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে এর মূল্য বৃদ্ধির প্রয়াস চালানো হচ্ছে যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কাজে আসবে বলে মনে করা হয়।
সিগারেটে প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যারা মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। তামাকে নিকোটিন নামে আরেকটি উপাদান আছে যা আসক্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী। ধূমপান করলে নিকোটিন মানসিক ও শারীরিক নির্ভরশীলতা তৈরি করে। অনুন্নত দেশগুলোতে যে সিগারেট বিক্রি করা হয় তাতে তামাকজাত উপাদান অনেক বেশি থাকে ফলে ওইসব অঞ্চলে ধূমপানজনিত ক্ষতি বা রোগসমূহ অনেক বেশি।
বর্তমানে দেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে যে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তার কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকারদের সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ।। উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়