ছবি : সংগৃহীত

এক.

কোন পথে আছি? পথ কি আমাদের জানা আছে?

অনেক প্রশ্ন আমাদের হুতাশ মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রতিদিন আমরা একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ঘোর কাটছে না কোনোকিছুতে। কেন কাটছে না, এখানেও প্রশ্ন। যতদিন যাচ্ছে প্রশ্নগুলো সংঘবদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু উত্তরগুলো ততটা নয়।

অস্থির একটা সময়ের মধ্যে আমরা দিন-রাত কাটাচ্ছি। হাপিত্যেশ আমাদের লেগে আছে। সংকোচ আমাদের গায়ে গায়ে লেগে আছে। শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি আমাদের চোখের সামনে তার সকরুণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের বাজারে এই অস্থিরতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তবে, মানুষ বড় ধৈর্যশীল। না হলে বাজারের আগুনে মানুষ স্ফুলিঙ্গের মতো জেগে ওঠার কথা। সেটা কই হচ্ছে?

মানুষ বড় অসহায়। তাদের চোখে অদৃশ্য জল। এই তাদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো, আলো দেখানোর মতো জাদুকরি নেতা নেই এই বঙ্গদেশে, আজ। আছে অধিকতর কাল্ট চর্চা, নানামুখী ‘জাতীয় নেতা’ অভিধা সিক্ত করার প্রবণতা। 

সাহিত্যের কথা বলি, কী বলি রাজনীতির কথা, প্রান্তজনের উপস্থিতি কোথাও নিষিদ্ধ নয়, তবু একটা নিষেধ থাকে। অলিখিত। নিষেধটা শ্রেণির। প্রান্তজন সাহিত্য সৃষ্টি করে না, রাজনীতিও তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না; সাহিত্যে যেমন, রাজনীতিতেও তেমনি, কর্তৃত্ব কেন্দ্রজন।

এরা প্রান্তজনকে জানে, তার দুঃখে সহানুভূতি জানায়, আর পক্ষে কথাও বলে, কিন্তু প্রান্তজনদের জন্য যে জায়গা করে দেবে তা পারে না। নিষেধ আসে বিচ্ছিন্নতা ও দূরবর্তিতা থেকে; দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে দাঁড়ায় স্বার্থের পাহারাদারি। প্রান্তজন ও কেন্দ্রজনদের স্বার্থ দেখা যায় পরস্পরবিরোধী।

দুই.

টাকার দাম পড়ছে। এর একটা মানে হলো, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিছুদিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মসলা, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে।

টাকার দাম পড়ে যাওয়ার আর একটা মানে হলো, বিদেশি মুদ্রার বাজারে টাকার নিরিখে আমেরিকান ডলারের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার কিনতে এখন বেশি টাকা লাগছে।

সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি দায় মেটানো যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগপণ্য, জ্বালানি, মূলধনী যন্ত্র ও কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে, সেই সাথে বেড়েছে জ্বালানি তেল। 

খুচরা বাজারে জিনিসের দাম—বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম—বাড়ছে কেন? একটা বড় কারণ নিশ্চয় পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। সারা পৃথিবী যখন একটু একটু করে করোনার কবল থেকে বেরিয়ে আসছিল, তখন অর্থনৈতিক লেনদেনও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল। ফলে পেট্রোল—ডিজেলের চাহিদা এবং দাম দুই-ই বাড়ছিল।

তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে ওই অঞ্চল থেকে পেট্রোলিয়ামের জোগান হঠাৎ কমে গেল, পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়া পেট্রোলিয়ামের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল, যুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে তেলের চাহিদা বাড়ল—সব মিলিয়ে পেট্রোল-ডিজেলের এখন আকাশছোঁয়া দাম।

পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ে, কাজেই সব জিনিসেরই দাম বাড়ার কথা। তার ওপর করোনার সময় সারা পৃথিবী জুড়ে যে জোগান ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছিল, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার বদলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাকে আরও বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। ফলে পৃথিবীর বাজারে সার্বিকভাবে জোগানে টান পড়ছে। কিন্তু এসব দিয়ে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ যদি বা বোঝা যায়, আলাদা করে খাদ্যপণ্যের দাম কেন বাড়ল, আর সেটা শহরের তুলনায় গ্রামে কেন বেশি বাড়ল, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

টাকার নিরিখে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে দু-একটা কথা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমাদের ডলার দিয়ে তেল কিনতে হয়। ডলারের দাম বেড়ে গেলে তেলের দাম আরও বেড়ে যায়, যার ফল আরও মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু শুধু টাকা কেন, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন সবকিছুর নিরিখেই তো ডলারের দাম বাড়ছে।

কারণ, বিদেশি মুদ্রা বাজারের মাতব্বররা মনে করছে বর্তমান পৃথিবীর টালমাটাল অবস্থায় আমেরিকান ডলারই সবচেয়ে নিরাপদ মুদ্রা। তাই তারা আর সব মুদ্রা বিক্রি করে ডলার কিনছে।

মজার কথা হলো, আমেরিকায় মূল্যবৃদ্ধির হার এখন ৮.৩%, যা আমাদের দেশ এবং আরও অনেক দেশের মূল্যবৃদ্ধির হারের থেকে বেশি। সেই দেশে ঋণাত্মক প্রকৃত সুদের হার এখন আমাদের দেশ এবং আরও অনেক দেশের থেকে কম। তবু কেন মতলববাজরা ডলার বা ডলার-বন্ডের দিকে ঝুঁকছেন, সেটা একটা ধাঁধা।

তিন.

আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, 'ভালো ভালো পোশাক পরা মানুষদের এখন টিসিবির লাইনে দেখা যাচ্ছে।' সম্ভবত মন্ত্রী এই মন্তব্য করার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের কোনো ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। বোঝাতে চাইলেন টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো শুধু দরিদ্র মানুষ ও ছেঁড়া কাপড় পরাদের কাজ নয়, ভদ্রলোকেরাও দাঁড়াতে পারেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যা ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা।

কাজেই ভালো কাপড় পরা মানুষদের এই লাইনে দেখাটা বেশ ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে। অথচ এই ভালো কাপড় পরা একজন সেদিন টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে জিনিস কেনার সময় তার ছবি তুলতে দেননি। তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, 'আমি চাই না আমাকে কেউ এখানে দেখুক।'

মধ্য আয়ের বাংলাদেশে এই হচ্ছে বাস্তবতা। এই বাস্তবতার সবচেয়ে করুণ দিক হচ্ছে অর্থমন্ত্রী আশা দিয়েছেন, 'আগামী অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় আরও বেড়ে হবে ৩ হাজার ৮৯ মার্কিন ডলার।' হয়তো তখন এই বর্ধিত মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাজারে দ্রব্যমূল্য কয়েক ধাপ বেড়ে যাবে এবং টিসিবির দেওয়া ন্যায্যমূল্যের পণ্য কেনার লাইন আরও লম্বা হবে।

অবশ্য জিডিপি বৃদ্ধি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য নিয়ে সন্দেহ এখনো রয়ে গেছে। ... কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো এমন নিম্নমানের তথ্য নেই। এটি বিশ্রী মনে হতে পারে, তবে সত্য সত্যই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য সবচেয়ে নিম্নমানের।' (২৩ জানুয়ারি ২০২০, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)

এই দেশের ‘অতি সাধারণ’ নাগরিক আমি। এই ‘অতি সাধারণ’ নাগরিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়, তুলনামূলক বেশি। অর্থনৈতিক বিষয় বোঝার মতো ক্ষমতা ‘আমাদের’ নেই বললেই চলে। জিডিপি, বৈদেশিক মুদ্রা আয়, ফরেন রিজার্ভ বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, এবং আধুনিক হিসেবে মাথাপিছু আয় গণনা করার বিষয়গুলো সম্পর্কে শুনি, কিন্তু সব বুঝতে পারি না। হজম করতে পারি না। কীভাবে যেন মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়।

ইদানীং এই আলাপ চলছে, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অথচ আমি এই আনন্দময় অনুভূতি বুঝতেই পারছি না। হয়তো অনেকে আমার মতোই এরকম নাদান। বরং বুঝতে পারছি সংসারের ব্যয়ের হিসাবটা কীভাবে বাড়ছে।

জনসংখ্যা আদতে কত তা নিয়েও আছে মতানৈক্য। উন্নয়ন সহযোগীসহ সবাই বলছেন দেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি, সেখানে বিবিএস বলছে সাড়ে ১৬ কোটি। তাহলে প্রকৃত জনসংখ্যা কত? অবশ্য জনসংখ্যা কম দেখাতে পারলে গড় মাথাপিছু আয় বেশি দেখানো সহজ হবে।

বাজারে জিনিসের মাত্রা ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, বাড়ি ভাড়া, তেল, গ্যাস, পানির দাম বেড়ে যাওয়ার হিসাব পত্রিকা পড়ে বা অর্থনীতিবিদ বা মন্ত্রীদের কথা শুনে বুঝতে হয় না। স্রেফ নিজের ব্যাগে হাত দিলেই বোঝা যায়। আমাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের পার্থক্য বাড়ছে তো বাড়ছেই। অন্যদিকে বাড়ছে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য।

অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়লেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বৈষম্য মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠেছে। কারণ বাংলাদেশেই ২০২০ সালে এত বেশি অতি ধনী মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে ঘটেনি।

যদিও ধনী মানুষ বাড়লে ‘মন্দের চেয়ে ভালো’ হওয়ার কথা। কারণ এই ধনিক শ্রেণি তখন দেশে টাকা বিনিয়োগ করেন। ফলে মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এমনটা হলেও এই দেশে হয় না। এই দেশের ধনী মানুষের ‘টাকা উড়ে উড়ে’ বাইরে চলে যায়। এরা দুবাই বা কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে তোলেন এবং বিদেশে বসে আরামে দিন কাটাতে টাকা ব্যয় করেন।

দুর্নীতি থেকে আয় হলেও মানুষ যেন লজ্জা না পায় সেজন্য আছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। আর তাই সাধারণ মানুষ টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে হয়রান হয়ে গেলেও বা লজ্জায় মুখ ঢাকলেও সরকার খুশি। কারণ, মাথাপিছু আয় বেড়েই চলেছে। এই বাড়তি টাকা মানুষের হাতে তাহলে কোথা থেকে আসবে?

চাইলেই বেতন বাড়বে না। তাহলে কি আমরা দুর্নীতি করে আয় বাড়াব? সংসার খরচ কমাতে গিয়ে প্রতিদিনের খাবার খরচ, সন্তানের জন্য খরচ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের খরচ, চিকিৎসা খরচ, বিনোদন খরচ—কোনটা কমাব? এ এক অন্তহীন প্রশ্ন।

চার.

বিভিন্ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ও অপরিকল্পিত ব্যয়, দুর্নীতি এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের কারণে দেশের অর্থনীতি খুব একটা স্বস্তিতে নেই। রিজার্ভ ব্যাংকে টান পড়েছে। মানুষের পকেটে টানাটানি চলছে। আর এদিকে উদ্বেগজনক মানবাধিকার পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সংকোচন ও বিরোধীদের সরকারি দলের অব্যাহত চাপের কারণে নানা ধরনের কথাবার্তা ডালপালা মেলেছে।

এইসব আলাপ আলোচনার মধ্যেই বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া নিশ্চিত করছে।  নানাবিধ চাপের মধ্যেই নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি জনজীবনকে আরও ‘কঠিন’ করে তুলবে। এর মানে বাজারে সবকিছুরই দাম বাড়বে আরও এক দফা।

মন্ত্রীরা এখন উন্নয়নের নানান ফিরিস্তি দেয়। আর এদেশের মানুষের দিন কাটে এসব শুনে শুনে। কিন্তু জনজীবনে এসব উন্নয়নের কোনো প্রতিফলন নেই; বরং নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সাধারণের জীবন। মানুষের হাপিত্যেশ বেড়ে গেছে। চাপা নীরব কান্নার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। তাহলে, আমাদের উন্নয়নের সুফল কোথায় যাচ্ছে?

হাবীব ইমন ।। সাংবাদিক