অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার
গ্রাম থেকে এক গরিব মানুষ তার সন্তানকে নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। বাচ্চার হার্টে নাকি ফুটো আছে। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নিলে এই ধরনের রোগীকে অবশ্যই ভর্তি করবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবে।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট বা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে আপনি বুঝতেই পারবেন না, এটা হাসপাতাল না বাজার। ফ্লোরে, বারান্দায় রোগী শুয়ে আছে। দেখে আপনার রাগ হতে পারে। কিন্তু ভরসাও কিন্তু এটাই। তারা কোনো রোগী ফিরিয়ে দেয় না।
বিজ্ঞাপন
বাজারের মতো হাসপাতালের চিত্র নিয়ে কয়েকবছর আগে হৃদরোগ ইনস্টিউটের তখনকার পরিচালকের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘চাইলে এই হাসপাতালও ঝকঝকে তকতকে রাখা সম্ভব। যদি আমরা আসনের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি না করি, তাহলেই হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন থাকবে। কিন্তু তাতে প্রতিদিন আমাদের হাসপাতালের গেটে মানুষ মারা যাবে। তাই আমরা কোনো রোগীই ফিরিয়ে দেই না। বারান্দায় রেখে হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করি। জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করি।’
গ্রামের সেই মানুষও তার সন্তানকে ঠিক জায়গাতেই নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার আগেই তিনি পড়েন দালালের খপ্পরে। সেই দালাল তাকে নিয়ে যায় মোহাম্মদপুর এলাকার একটি হাসপাতালে। কিন্তু দুই দিন থাকার সেই গ্রামের মানুষটিও বুঝে গেলেন, তিনি ভুল হাসপাতালে এসেছেন।
তার দৃষ্টিতেই সেটিকে কোনো হাসপাতালই মনে হচ্ছিল না। পরে তিনি কোনোভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। আমি পরে সেই শিশুকে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থার করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তার মতো অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন দালালের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়, সর্বশান্ত হয়, চিকিৎসা বঞ্চিত হয়।
বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলোর চারপাশেই এমন অসংখ্য ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। যেগুলো নামে হাসপাতাল হলেও আসলে কসাইখানা। ভালো ডাক্তার নেই, টেকনিশিয়ান নেই, চিকিৎসা সহায়তাকারী নেই, যন্ত্রপাতি নেই। শুধু আছে মানুষের পকেট কাটার সকল আয়োজন।
বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলোর চারপাশেই এমন অসংখ্য ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। যেগুলো নামে হাসপাতাল হলেও আসলে কসাইখানা। ভালো ডাক্তার নেই...
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল আছে, যেগুলো হাসপাতাল না ফাইভ স্টার হোটেল বোঝা মুশকিল। সেসব হাসপাতাল নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। বিশেষ করে তাদের আকাশ ছোঁয়া বিল নিয়ে অভিযোগ করার কোনো জায়গা নেই।
তাও আপনি টাকা দিয়ে চিকিৎসা পাবেন। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে আপনি টাকা দিয়েও চিকিৎসা পাবেন না। কারণ চিকিৎসা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই তাদের।
টাকা দিয়ে আমরা যে টেস্টগুলো করাই তার কয়টা সঠিক তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। মোটামুটি চেনা এক হাসপাতালের এক ডাক্তারের সাথে অতিরিক্ত টেস্ট দেওয়া নিয়ে কথা বলছিলাম। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, ‘আমি যদি তাদের চাহিদামতো টেস্ট না দেই, দুই মাসের মধ্যে এই চেম্বার আমার ছাড়তে হবে। একটি নামকরা হাসপাতালে এমন চমৎকার চেম্বার ছাড়ার ঝুঁকি নেওয়ার মতো সাহস আমার নেই। তাই হাসপাতালের চাহিদা মেনেই আমাকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে টেস্ট দিতে হয়।
এরপর তিনি যেটা বললেন, তাতে আমার আক্কেলগুড়ুম, ‘টেস্ট দিচ্ছি, সেটাও যদি সঠিক রিপোর্ট পেতাম, মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গড়পড়তা রেজাল্ট দেওয়া হয়।’
হাসপাতালে এসেই একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করেন, আজ ক্রিয়েটিনাইন কত চলছে? মনের দুঃখে সেই ডাক্তার দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু আমাদের সবার তো দেশ ছাড়ার উপায় নেই, সামর্থ্য নেই। আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছেন, যারা জ্বর হলেও ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর চলে যান। কিন্তু কোটি কোটি মানুষকে কিন্তু এই চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর ভরসা করেই বেঁচে থাকতে হয়।
ভাগ্য খারাপ হলে টুপ করে মরে যান। বেঁচে থাকাটাই এখানে মিরাকল। আমি নিজে আমার সব চিকিৎসা দেশেই করানোর চেষ্টা করি। কিন্তু মোটামুটি সামর্থ্য থাকলে আমি মানুষকে চিকিৎসার জন্য অন্তত পাশের দেশ ভারতের চলে যাওয়ার পরামর্শ দেই। বাংলাদেশে এই হাসপাতাল সেই হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে অর্থ ব্যয় করে প্রতারিত হওয়ার চেয়ে পাশের দেশে যাওয়া অনেক ভালো।
করোনার সময় রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণার খবর তো সারাদেশের মানুষ জেনেছে। রিজেন্টের সাহেদ এখনো কারাগারে আছে। কিন্তু আমি তখনো বলেছি, এখনো বলছি, দেশে রিজেন্টের মতো অনেক ভুয়া হাসপাতাল আছে, সাহেদের মতো অনেক টাউট আছে। কিন্তু কীভাবে আছে?
বাংলাদেশে তো আইন-কানুন, বিধি-বিধান আছে। একটা মুদি দোকান খুলতেও যেখানে অনুমতি লাগে, সেখানে কীভাবে দিনের পর দিন লাইসেন্সহীন, মানহীন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলতে পারে? মানুষকে দিনের পর দিন প্রতারিত করতে পারে।
চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। পর্যাপ্ত সরকারি হাসপাতাল না থাকলেও মানুষ যাতে টাকা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারে তা নিশ্চিত করা অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব।
চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। পর্যাপ্ত সরকারি হাসপাতাল না থাকলেও মানুষ যাতে টাকা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারে তা নিশ্চিত করা অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব।
হাজার কোটি টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেল বানাতে পারলে আমরা সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড নিদেনপক্ষে ভারতের মতো ভালো কয়েকটা হাসপাতাল বানাতে পারব না কেন? যেখানে গেলে মানুষ নিশ্চিন্তে, ন্যায্যমূল্যে ভালো চিকিৎসা পাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হঠাৎ করেই দেশজুড়ে অনুমোদনহীন, মানহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে। ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এরইমধ্যে দেশের বিভিন্নস্থানে শতাধিক ক্লিনিক বন্ধ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে নানান চিত্র দেখা যাচ্ছে। রোগীকে অপারেশন টেবিলে রেখে ভুয়া ডাক্তারের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, তাদের এই কঠোর অভিযান অব্যাহত থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর সবার নাগের ডগায় এই ক্লিনিকগুলো চলছিল কীভাবে? আমরা দেখেছি, করোনার সময় প্রতারক সাহেদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে চুক্তি সই করছে।
অধিদপ্তরের কারো না কারো সহায়তায়ই দিনের পর দিন চিকিৎসার নামে এই প্রতারণা, এই ডাকাতি চলে আসছে। ভুয়া ক্লিনিকের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি নিজেদের ঘরের দিকে নজর দেয় তাহলে ভালো হয়।
দেরিতে হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি অতি প্রয়োজনীয় অভিযান শুরু করেছে, এই জন্য তাদের ধন্যবাদ। এই শুদ্ধি অভিযান শেষে যদি বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হয়, চিকিৎসার জন্য যদি কাউকে দেশের বাইরে যেতে না হয়, তাহলেই সবার জন্য মঙ্গল।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ