‘আমি কি ভুলিতে পারি?’
গাফ্ফার ভাই, আপনি এলেন, অবশেষে। এর আগে যে কবার আপনি দেশে এসেছেন—আপনি আসছেন জানার পর থেকে অধীর অপেক্ষায় থাকতাম। আপনি আসছেন, অথচ এক বিমর্ষব্যথা আমার হৃদয়ে বর্শার মতো বিঁধে রয়েছে।
এবারের মতো শেষ আসা আর তো কখনো আসেননি। আর তো কখনো আসবেনও না। জীবনানন্দ দাশ যেমনটি লিখেছেন—
বিজ্ঞাপন
‘একে একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ;
কার লাগি হে সমাধি, তুমি একা ব’সে আছো আজ—।’
গাফ্ফার ভাই, আপনাকে ভুলতে পারি না এক মুহূর্তের জন্যও। কাজী নজরুল ইসলাম যেমনটি বলেছেন—
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’
আপনি দূরে চলে গেছেন, আপনাকে ভোলার প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু সত্যিই কি আপনি দূরে চলে গেছেন?
যখন কবিতার কথা ওঠে, আপনাকে মনে পড়ে। যখন ব্যক্তিগত আলাপচারিতার কথা হয়, অভিভাবক হিসেবে কোনো ঘটনা বা সংবাদ নিয়ে কারো সঙ্গে গভীর মননে কথা বলতে ইচ্ছে হয়—তখন আপনার টেলিফোন নাম্বারটা হাতড়ায়। কিন্তু আর আপনাকে পাই না। পাই না, কিন্তু আমার হৃদয়ে আপনার যে পাঠ গেঁথে আছে, সেই অমূল্য পাঠ আমাকে সঙ্গ দেয়।
প্রিয় গাফ্ফার ভাই, আপনি যে কতখানি ছিলেন আমার ভেতরে, তা আজ মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারছি। আপনি তো কেবল আমার আপনজন নন, আমার পরিবারেরই একজন।
আমার পরিবারের সকলের সঙ্গে ছিল আপনার নিবিড়-মাধুর্যময় সম্পর্ক। মনে পড়ে সেই শৈশবের কথা। তখনো আমি ছাত্র, আপনি আমাদের বাসার উঠোনে বসতেন, কত কথা বলতেন কতশত বিষয় নিয়ে। ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকত আপনার নির্মল হাসি।
এসব স্মৃতি আজ আমার হৃদয় সিন্দুকে রয়েছে অমূল্য মণিমুক্তার মতো। আপনি কলকাতায় গেলে আপনার সঙ্গ পেতে আমি কলকাতায় ছুটে যাই। অনেক কষ্টে শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আপনাকে দেখতে লন্ডনে ছুটে যাই। আমার পুত্র প্রিয় গিয়ে দেখে আসে আপনার শারীরিক অবস্থা।
আমার কত বড় সৌভাগ্য, আপনি আমাকে এবং আমাদের সবকিছুকে নিজের মতো করে নিয়েছেন। আমাকে আপনি ‘ছোট ভাই’ তুল্য জ্ঞান করতেন, বিভিন্ন জায়গায় আমার সম্পর্কে সপ্রশংস কথা বলতেন।
আপনি আমাদের উত্তরার বাসায় এসে বলতেন, ‘মানস ঘোষ, আমার আর তোমার—আমাদের তিনজনের বউয়ের নাম শেলী।’ কত বিচিত্র বিষয়ে আমরা আড্ডায় ডুবে যেতাম। বিভিন্ন জায়গায়, আপনার সঙ্গে যখনই দেখা হতো, গভীর আলাপে আমরা মশগুল হয়ে যেতাম।
আপনি বরিশালের কথা বলতেন, গ্রামের কথা বলতেন। কত মানুষের স্মৃতি আপনি তুলে ধরতেন। যখন আপনার পাশে বসতাম, আপনার সঙ্গে কথা বলতাম, সময় কোথা দিয়ে উড়ে চলে যেত। তৃষ্ণা মিটত না।
আমার মনে হতো যে, আমি ইতিহাসের সঙ্গে কথা বলছি, আমি ইতিহাসকে দেখছি। সেই আপনি আর কোনো দিন আমাদের বাড়িতে আসবেন না! লন্ডনে গিয়ে আপনার দেখা আর কোনো দিন পাব না!
আপনাকে অনেকবার বলেছি—আমি আপনার মতো কখনো হতে পারব না, কিন্তু আপনার ভাবশিষ্য হয়ে ওঠাই আমার জন্য অনেক বেশি আনন্দের। আপনি যখন কোনো একটা বিষয় নিয়ে লিখতেন, তখন আপনার ভেতরে একটা অসামান্য শক্তি কাজ করতো।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস— সবকিছু নিয়ে আপনি কথা বলতেন। নেতা কিংবা রাজনীতিক অথবা সরকারের ভুলভ্রান্তি নিয়ে কথা বলতেন এবং নানাভাবে আমাদের আলোচনায় উঠে আসত নেপথ্য সত্যকথন।
আমি আপনাকে ছাড়তে চাইতাম না। কিন্তু আপনার অনেক ভক্ত, অনেক গুণগ্রাহী অপেক্ষা করতো আপনার জন্য। তারা এসে ভিড় করতো আপনার চারপাশে। একপর্যায়ে আমি হারিয়ে যেতাম আপনার গুণগ্রাহীদের স্রোতে।
আপনি যে অসাধারণ বন্ধুবৎসল ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ভিন্ন মতাদর্শের বন্ধুদের প্রতি আপনার আন্তরিক ব্যবহারে। যেমন শফিক রেহমান। তাকে আপনার বন্ধু হিসেবে স্বীকার করতে কখনো কুণ্ঠিত হতে দেখিনি।
স্মৃতিচারণের সময় আপনি আপনার ভিন্ন মতাদর্শের বন্ধুদের ব্যাপারে প্রশংসা করতে কখনো কার্পণ্য করেননি। কারো ব্যাপারে অসূয়া মনোভাব কখনো প্রকাশ পায়নি আপনার মধ্যে।
গাফ্ফার ভাই, নিজের হাতে আপনি কতশত একলব্য তৈরি করেছেন—আপনি হয়তো জানতেন না। কতজন আপনাকে দ্রোণাচার্য মনে করে আপনার সাধনা করে গেছেন একলব্যের মতো—আপনি তাদের সংখ্যা জানতেন না।
শুধু আমি নই, আরও অসংখ্যজন আপনার ছায়ার মধ্যে দিনযাপন করতো। দুষ্টজনে যখন আপনার সমালোচনা করে বলে, আপনি মিথ্যা রেফারেন্স দেন, মৃত ব্যক্তিদের কথা উদ্ধৃত করেন এবং কোনো সাক্ষী রাখেন না—এই বিষয়ে আপনাকে আমি যখন প্রশ্ন করেছি আপনি বলেছেন—আমি তো ঐ মৃত লোকদের আনতে পারব না। বলেই হেসেছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ইতিহাসের সেই অংশগুলো বিভিন্ন সময় বারবার অবিকল তুলে ধরেছেন।
এই আপনাকে আর কোনো দিন ফিরে পাব না! কিন্তু আপনাকে তো হারাতেও পারব না গাফ্ফার ভাই। এজন্য এক অসীম শূন্যতা আমাকে গ্রাস করেছে। এই শূন্যতা আমার অভিভাবক হারানোর শূন্যতা, এই শূন্যতা আমার বন্ধুশূন্যতা।
আমার চৈতন্যের যে সাথি—যেকোনো সংকটে জটিলতায় কিংবা বিশেষ ঘটনার সময় যার সঙ্গে একটু আলোচনা করে নেওয়া দরকার—সেই চৈতনের সাথিকে হারানোর শূন্যতায় আমি ডুবে রয়েছি। আমি আর পাব, আপনাকে আমি আর পাব না, কোনো দিনই পাব না।
কত বেদনা কত কষ্ট আপনি হাসিমুখে ধারণ করেছেন, নীলকণ্ঠ হয়েছেন। সেই যে কবি আহসান হাবীব বলেছেন, ‘যে যায় সে যায়, ফিরে আসে না।’
আপনি চলে গেছেন, এবার ফিরে এসেছেন বাংলায়। বাংলার মাটিতেই আপনি আপনার শেষ শয্যা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। জীবনানন্দ দাশের মতো বাংলার মাটিকে ভালোবেসে চিরনিদ্রায় ডুবে যাবেন আপনি—
‘তবু যেন মরি আমি এই মাঠ-ঘাটের ভিতর,
কৃষ্ণা যমুনার নয়—যেন এই গাঙুরের ঢেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখে মুখে—।’
সেই আপনি আজ দেশে এসেছেন। আমার ছুটে যাওয়ার কথা, বরাবরের মতো। কিন্তু আমার দুই পায়ের ওপর যেন জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে। আপনি অপূর্ব হাসিমুখের পরিবর্তে আমি কী করে দেখব আপনার নিষ্প্রাণ মুখ?
আমি পারব না, কিছুতেই পারব না ফ্রিজারের মধ্যে নীলশীতল হয়ে থাকা আপনার ঐ মুখের দিকে তাকাতে। সাদা কাপড়ে মোড়া আপনার শরীর আমাকে প্রতি মুহূর্তে ভেঙে ফেলবে। অনেক আগে ‘চলমান শবদেহ’ নামের একটি কবিতায় আমি লিখেছিলাম—
‘যে মারা যায়, সে একাই যায়
একাকী নিঃসঙ্গ উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টির সামনে
থাকে না কোনো নিকট পরিজনের অবয়ব
ছায়া ছায়া মানুষেরা দূর থেকে দেখে যায় বিষণ্ন চোখে
তারপর চলে যায় নৈমিত্তিক জীবনের চাহিদা মেটাতে।
ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে সকলেই সময় সাজায়
তারই ফাঁকে ঘুরে যাওয়া দেখে যাওয়া সেই চেনা মুখ
যার সঙ্গে আছে খণ্ড স্মৃতির মিছিল।...’
আমি আপনাকে শেষবারের মতো দেখার কাফেলায় পা মেলাতে পারব না গাফ্ফার ভাই। আমাকে ক্ষমা করবেন। ৬৫ বছর ধরে আমাদের পরিচয়! প্রতি মুহূর্তে আমি এই কথাটাই উপলব্ধি করি—আপনি আমার জীবনের একমাত্র ব্যক্তি—যিনি আমার শৈশব দেখেছেন, কৈশোর-যৌবন পার করে এই প্রায় অশীতিপর স্পর্শ করা জীবনের অলিগলি আপনি প্রত্যক্ষ করেছেন।
আমি এই বয়সে আপনাকে আর হারাতে পারব না। কিছুতেই হারাতে পারব না প্রিয় গাফ্ফার ভাই। আর অমর গানের মতোই বলতে চাই—আমি কি (আপনাকে) ভুলিতে পারি?
আবেদ খান ।। সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ