খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য : দিশেহারা প্রান্তিক মানুষ
নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্য। সাধারণ মানুষের মৌলিক খরচের খাতায় কাটছাঁট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পারিবারিক ব্যয় সংকোচন করে অনেকেই টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা- সব খাতেই প্রয়োজনীয় খরচের বোঝা বইতে না পেরে মানুষ খরচ কমানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন।
মধ্যবিত্তরা বোবা হয়ে গেছেন। নিম্নমধ্যবিত্তরা টিসিবির পণ্যের জন্য দীর্ঘ সারিতে দাঁড়াচ্ছেন। আর স্বল্পআয়ের মানুষের দুঃখ এখন সীমাহীন। মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকার কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্য দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেখানেও কালো হাতের থাবা।
উপকারভোগী নির্বাচনে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম চরমে। সামাল দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা দেশের মূল্যস্ফীতির বিষয়টিকে সামনে আনছেন।
বিজ্ঞাপন
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক ব্যয়বৃদ্ধিতে কষ্টে আছেন এবং দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। মূল্যস্ফীতি দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিচ্ছে। নতুন করে অনেককে দারিদ্র্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন।
মূল্যস্ফীতির চাপ যেমন সামলানো যাচ্ছে না, তেমনি নিত্যপণ্যের দামেও লাগাম টানা যাচ্ছে না। কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে আটকে ছিল, সেটি এখন ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। মজুরি সূচক ও মূল্যস্ফীতি প্রায় কাছাকাছি চলে আসছে।
ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে খাদ্যপণ্যসহ সকল পণ্য ও সেবার দাম বাড়াতে মরিয়া ব্যবসায়ী ও সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও দেশের মানুষের আয় বেড়েছে বলে সরকারি দলের কিছু নেতাও ব্যবসায়ীদের সাথে সুর মিলান। প্রকৃত অর্থে কি সেটা, নাকি এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে?
মূল্যস্ফীতির চাপ যেমন সামলানো যাচ্ছে না, তেমনি নিত্যপণ্যের দামেও লাগাম টানা যাচ্ছে না। কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে আটকে ছিল, সেটি এখন ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীরা মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে চাহিদা ও জোগানের ওপর বাজার নির্ভর করে বুলি আওড়ালেও সাম্প্রতিক সয়াবিন তেলের মজুতদারি নিয়ে মিলমালিক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা যেভাবে পুরো দেশকে তেলের খনিতে পরিণত করেছেন। সেখানে প্রকৃত দৃশ্য ভেসে উঠেছে। প্রমাণ হলো চাহিদা ঠিক থাকলেও জোগান, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। আর ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান ছাড়া সরকারের আর কোনো কর্তৃপক্ষকে জনগণ মাঠে না পেয়ে হতাশার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন।
খাদ্যপণ্যের এই মহা ঊর্ধ্বগতির মাঝে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকিতে আছে বলে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ও ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাব থেকে বারবার বলা হলেও নীতি নির্ধারণকারীদের কান অবধি পৌঁছাতে কালক্ষেপণ হচ্ছে।
সারা দেশে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বেকারির খাবারে। তাই মহাবিপাকে পড়েছেন সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ। কিন্তু খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতিদিন দুই বেলায় খরচ হচ্ছে ১৫০ টাকা।
এদিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) এক জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালের আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে খাবারের ব্যয় কমিয়েছে বড় অংশের মানুষ। সর্বশেষ এই হার দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। এর বাইরে কেউ কেউ সঞ্চয় ভেঙে চলছেন।
আবার কেউ কেউ বাধ্য হয়ে কোনো রকমের দরকষাকষি ছাড়াই নিম্নমজুরির কাজে যোগ দিয়েছেন। ২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানায়, করোনার প্রভাবে দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন।
ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপের তথ্য বলছে, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। এই জরিপের ফল প্রকাশ করা হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে।
২০২১ জানুয়ারিতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানিয়েছিল, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ, যা করোনার আগে ২১ শতাংশের মতো ছিল। যদিও সরকার নতুন দরিদ্রের বিষয় নাকচ করে দিয়েছে।
সারা দেশে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বেকারির খাবারে। তাই মহাবিপাকে পড়েছেন সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ।
শুধু দরিদ্র ও হতদরিদ্ররাই নয়, নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরাও। বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের আমিষ জাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়েছে।
এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পুষ্টির অভাব দেখা দিচ্ছে। এতে অবনতি ঘটছে তাদের স্বাস্থ্যের। তাছাড়া এসব পরিবারকে কমিয়ে দিতে হচ্ছে শিক্ষা খাতে ব্যয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থী। সংকোচন করতে হচ্ছে পরিবারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই খাদ্যের মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের কাছে বড় কষ্টের।
করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে যখন ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করার এই প্রক্রিয়ায় মজুরিও বাড়ে। কিন্তু সেই বাড়তি মজুরির টাকা খেয়ে ফেলছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
এখন মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে। সাধারণত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে। অর্থনীতির সেই চিরায়ত প্রবণতায় উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মজুরিও বাড়ে। মজুরি বেশি বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতির আঁচ টের পান না তারা। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হলে মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এখন বাংলাদেশে তাই হয়েছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যও তাই বলছে। অর্থাৎ এখন দেশের দিনমজুর-শ্রমিকেরা যা উপার্জন করছে বা যা মজুরি পাচ্ছে, তা দিয়ে তাদের সংসার চলছে না। হয় ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে, না হয় অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য কম কিনছে বা কম খাচ্ছে, সঞ্চয় করা বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানো তো দূরে থাক।
প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষের একটি অংশ খাবারের জন্য হোটেল রেস্তোরাঁর ওপর নির্ভরশীল। ভোজ্যতেল, চাল, ময়দা, মাছ-সবজির কিংবা পেঁয়াজ, ডালসহ মতো সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে বেড়ে গেছে হোটেল-রেস্তোরাঁর সব রকম খাবারের দাম। তাছাড়া হোটেল ব্যবসায় লাইসেন্সের ফি বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে হোটেল মালিকেরা খাবারের দাম বাড়িয়েছে।
এক দিকে নিত্যপণ্যের দাম পাল্লা দিয়ে বাড়লেও আয় বা বেতন বাড়েনি। মাসের বেতনের টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বদলে গেছে মূল্য তালিকা। আবার অনেক হোটেল মালিক দাম না বাড়িয়ে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। এতে ঠিকমতো পেট ভরছে না ভোক্তাদের। শিঙাড়া, সমুচার মতো খাবারের দাম বেড়েছে আগের চেয়ে দেড় গুণ। সংসার খরচে ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি এভাবে হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
এক দিকে নিত্যপণ্যের দাম পাল্লা দিয়ে বাড়লেও আয় বা বেতন বাড়েনি। মাসের বেতনের টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে আবার হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বেড়ে গেছে। ফলে এখন আধা পেট খেয়ে জীবন চালাতে হচ্ছে। যাদের দিনে কয়েকবার একটি রুটি, একটি কলা খেতে হয়, সেই শ্রমজীবী মানুষও বিপাকে পড়েছেন। সীমিত আয়ের অনেক মানুষ এখন দুপুরে রেস্তোরাঁয় বাড়তি ব্যয়ে খাওয়ার বদলে রুটি-কলা খেয়ে দিন কাটান।
বর্তমান সৎভাবে জীবন যাপনকারী স্বল্প আয়ের মানুষ ও চাকরিজীবীদের বেতন বাড়েনি। নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা ও দেশের কেউ পাচ্ছে না। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোথাও বাজার বিকৃতি ঘটছে কি না, বিপণন ব্যবস্থায় সমস্যা হচ্ছে কি না, ক্ষুদ্র কোনো গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করছে কি না সবকিছু অনুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।
প্রকৃত কারণে দাম বাড়লে সর্বসাধারণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে তার জন্য সরকারি উদ্যোগে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর মতো উদ্যোগ নেওয়া।
বিকল্প ব্যবস্থাপনায় চাল, ভোজ্যতেল, আটা, চিনি, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্য প্রান্তিক, শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করতে হবে।
আমদানিকারক, উৎপাদক, পরিবেশক, সরবরাহকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে সমন্বিত বাজার (ভোক্তা ও গণমাধ্যম প্রতিনিধি সমন্বয়ে) তদারকি নিশ্চিত, টিসিবি, সর্বোপরি ট্যারিফ কমিশন, কৃষি, খাদ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। সব পর্যায়ে ভোক্তা সংক্রান্ত নীতি নির্ধারনীতে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ ও মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
ব্যবসায়ীদের কূটকৌশল রোধে ভোক্তা অধিকার শিক্ষাকে জোরদার করতে হবে। প্রতিবেশী ভারতে নীতি ও অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষের ওপর দাম অভিঘাত প্রশমনে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো নিত্যপণ্য মূল্যে বৃদ্ধি কারণে সরকারের সব উন্নয়নের কৃতিত্ব ব্যর্থ হয়ে যাবে।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)