শ্রীলঙ্কা : সংকট থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এখন নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে। অথচ বছর কয়েক আগেও দেশটি আর্থ-সামাজিকভাবে এবং মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল। ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে দেশটি তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, সরকারি ঋণের বিশালতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগার খালি করাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশটি মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করতে পারছে না। খাদ্য ও জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী।
বিজ্ঞাপন
বিদ্যুৎ বিপর্যয় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করেছে। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি প্রবল। অনেকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিকে মানবিক বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন। এমতাবস্থায়, জনগণের আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগের পর আবারও নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে নতুন শ্রীলঙ্কান প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে। ‘সংকটের ত্রাতা’ হিসেবে খ্যাত ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ (৯ মে) পাওয়ার পরে গত ১৪ মে আরও নতুন চার মন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নতুন মন্ত্রী হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা হলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রফেসর জামিনী লক্ষণ পেইরিস, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দীনেশ গুনাবর্ধনে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রী পদে নিয়োগ পেয়েছেন কাঞ্চা ওয়াইজেসেকরা এবং পল্লী উন্নয়ন ও গৃহায়ণমন্ত্রী হিসেবে প্রসন্ন রানাতুঙ্গাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, বিক্রমাসিংহে এর আগে পাঁচ বার বিভিন্ন মেয়াদে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যদিও ২২৫ আসন বিশিষ্ট শ্রীলঙ্কান পার্লামেন্টে ইউএনপির আসন রয়েছে মাত্র ১টি। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের ২২৫ জন এমপির মধ্যে ১৬০ জনই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন দিয়েছেন বিক্রমাসিংহেকে। এছাড়াও শ্রীলঙ্কায় নতুন সরকার গঠনে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহেকে সমর্থন দেবেন বলে জানিয়েছে শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টির (এসএলএফপি) নেতা মাইথ্রিপালা সিরিসেনা।
এদিকে বিক্রমাসিংহে নির্দলীয় সরকার গড়তে বিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত করতে সব দলকে হাত বাড়িয়ে সমন্বিত চেষ্টা চালাতে হবে। তিনি আরও বলেন, দলীয় রাজনীতি পাশে সরিয়ে রেখে সবার জনগণের মুখোমুখি হওয়া উচিত।
ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে দেশটি তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বিলম্ব না করে টেকসই অর্থনীতি গড়া উচিত। অধিকন্তু, ভারত নতুন প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়েছে এবং ভারতের হাইকমিশন বলেছে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসারে গঠিত শ্রীলঙ্কার সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ। তিনি শ্রীলঙ্কার দুঃসময়ে পাশে থাকা ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ায় ভারতকে ধন্যবাদ জানান রনিল বিক্রমাসিংহে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে ঋণ ও আর্থিক সহায়তা বাবদ ৩ কোটি ডলারের বেশি অর্থ দিয়েছে ভারত। আপাত দৃষ্টিতে এই পরিবর্তনগুলো ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছিল। অনেকে প্রত্যাশা করেছিল রাজনৈতিক পরিবর্তন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। কিন্তু নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগকে ঘিরে নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার বাকি চারজন মন্ত্রীর নিয়োগে নিয়োগে জনগণের বড় অংশই সন্তুষ্ট নয়। কারণ, রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রভাবশালী রাজাপকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠ মনে করা হয় এবং এই চারজন মন্ত্রীই গত মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাচ্ছে দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। বিক্রমাসিংহেকে প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল সামাগি জানা বালাওয়েগায়া (এসজেবি)। দলটি বলছে, ‘সরকার গঠনের কোনো ম্যান্ডেট রনিল বিক্রমাসিংহের নেই। আমরা তাকে চ্যালেঞ্জ করছি, পার্লামেন্টে ১১৩টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করুন।’
তবে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে বলেছেন, তিনি আগামী সপ্তাহে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দেবেন। পাশাপাশি, দলটি জানায়
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী জোট সরকারে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে তারা দেশে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের বক্তব্য ‘এটা ইতিমধ্যে পরিষ্কার—নতুন প্রধানমন্ত্রী আসলে প্রেসিডেন্টের আজ্ঞাবহ। এই দেশ চায় রাজাপাকসেরা বাড়ি ফিরে যাক এবং আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
এদিকে প্রেসিডেন্টের নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে বিরোধী দল। তারা বলছে, নতুন মন্ত্রিসভায় তারা অংশ নেবে না। এতে গোতাবায়ার ঐক্যের সরকার গড়ার প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসজেবি বলছে, তারা তথাকথিত ঐক্য সরকারে যোগ দেবে না। একসময় রাজাপক্ষে সরকারের ঘনিষ্ঠ কিন্তু এখন স্বতন্ত্র দল শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি বলছে, তারা মন্ত্রিসভায় যাবে না। পার্লামেন্টে নতুন সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করার জন্য সংসদ সদস্যদের অর্থ দিয়ে কেনার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই প্রসঙ্গে এসজেবির নেতা ও সংসদ সদস্য রাজিথা সেনারত্নে গতকাল বলেন, রনিল বিক্রমাসিংহের সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য তাকে অর্থ দিতে চাওয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় আজ নতুন আরও ১৬ জন মন্ত্রী শপথ নেবেন। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ জন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নতুন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার গঠন ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সার্বিকভাবে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার সামনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং সমঝোতার বিকল্প নেই।
সামাগি জনা বালাওয়েগায়া (এসজেবি), শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি) ও শ্রীলঙ্কা পদুজনা পেরামুনার (এসএলপিপি) সদস্যরা নতুন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেতে পারে বলে জানা গেছে। মন্ত্রিসভার ১০টি পদ পেতে পারে এসএলপিপি। বাকি পদ যাবে এসএলএফপি ও এসজেবির কাছে।
কোন দলের সদস্যদের কাছে কোন পদ যাবে তা নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। তবে প্রধান বিরোধী দল এসজেবি হয়তো মন্ত্রিসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে এসএলএফপি এবং এসএলপিপি অধিকাংশ পদ দেওয়া হলে এসজেবি সেটিকে হয়তো মানতে চাইবে না। তখন সংকট নতুন মোড় নিতে পারে।
অধিকন্তু, বিরোধী দলের প্রবীণ আইনজীবী হারশা ডি সিলভা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তিনি বলেন, ‘জনগণ রাজনৈতিক নাটকীয়তা বা সমঝোতা চাচ্ছে না, তারা এমন একটি টেকসই ব্যবস্থা চাচ্ছে যাতে তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পারে।’
নতুন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার গঠন ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সার্বিকভাবে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার সামনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং সমঝোতার বিকল্প নেই।
অর্থনৈতিক সংঘাতকে পুঁজি করে বিরোধী দলের অনড় এবং আপসহীন মনোভাব শ্রীলঙ্কার জন্য আরও বিপদ ডেকে আনবে। ইতিমধ্যে এলটিটিই’র পুনর্জাগরণ কিংবা তামিলরা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দুর্বল শ্রীলঙ্কা সার্বিকভাবে সংকটকে আরও বিপদজনক করে তুলবে।
ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে বৃহৎ শক্তিগুলো শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকট তথা অস্থিতিশীলতাকে ব্যবহার করে তাদের প্রভাব বহুগুণে বৃদ্ধির চেষ্টা করবে। ফলে অর্থনৈতিক সংকটের দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। এবং তার জন্য প্রয়োজন রনিল বিক্রমাসিংহেকে সহযোগিতা করা, প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করা এবং শ্রীলঙ্কার জনগণকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর বিশেষ নজর দেওয়া। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
ড. দেলোয়ার হোসেন ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত