শফিকুলের পরিবর্তে শরিফুল
রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেওয়া বিনা টিকেটের তিন যাত্রীকে জরিমানা করে ট্রেনের টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) শফিকুল ইসলামের বরখাস্ত হওয়ার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি ১৬ মে রিপোর্ট দিয়েছে। তাতে শফিকুল ইসলামকে নির্দোষ বলা হলেও নির্দোষ এই লোকটিকে অপদস্থকারী মূল দুই ব্যক্তি-রেলমন্ত্রীর স্ত্রী এবং পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিনের ব্যাপারে কিছু বলা নেই। দেখা যাচ্ছে, এই তদন্ত রিপোর্ট এমন কেন হলো তা নিয়ে আরেকটি তদন্ত হওয়া দরকার।
তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শহিদুল ইসলাম রিপোর্টের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ওই রাতে মন্ত্রীর আত্মীয় যাত্রীদের সঙ্গে টিটিই’র কোনো বাদানুবাদ হয়নি। ট্রেনের গার্ড শরিফুল ইসলামের সঙ্গে টিটিই শফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল। এজন্য শরিফুল ওই তিন যাত্রীকে প্ররোচিত করে তাদের একজন ইমরুল কায়েসকে দিয়ে টিটিই শফিকুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করান।
বিজ্ঞাপন
ওই দিনের ঘটনার সঙ্গে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে জানতে চাইলে রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার পর যে কর্মকর্তা (বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন) টিটিই শফিকুলকে বরখাস্ত করেছিলেন, তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশের জবাব পেলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। আজকে (১৬ মে ২০২২) যে তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার সময় অনুপস্থিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে কিছু নেই, এটা শুধু ট্রেনের ভেতরের ঘটনা নিয়ে।’
ওই রাতে মন্ত্রীর আত্মীয় যাত্রীদের সঙ্গে টিটিই’র কোনো বাদানুবাদ হয়নি। ট্রেনের গার্ড শরিফুল ইসলামের সঙ্গে টিটিই শফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল...
তার মানে তুমুল আলোচিত একটি ঘটনার তদন্ত হলো আংশিক। বাকিটা কেন হলো না তা বুঝতে কিছু তথ্য ফের স্মরণ করতে হবে। সেই রাতে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রী শাম্মী আক্তার তার মামাতো বোন ইয়াসমিন আক্তারের ঈশ্বরদীর বাড়িতে ছিলেন।
বিনা টিকেটের যে ৩ যাত্রীকে জরিমানা করা হয়েছিল তাদের একজন হলো, ইয়াসমিনের ছেলে ইমরুল কায়েস প্রান্ত। ইয়াসমিন পরে একাধিক গণমাধ্যমকে জানান, ছেলে তাকে ফোন করে ট্রেনে ঝামেলার কথা জানালে তিনি তার পাশেই থাকা রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তারকে ব্যাপারটি জানান।
মন্ত্রীর স্ত্রী তখন রেলওয়ের একজন কর্মকর্তাকে ফোন করে টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করতে বলেন। ইয়াসমিনের এই বক্তব্য তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
৮ মে ২০২২, রেল ভবনে সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনও স্বীকার করেন ৩ আত্মীয়কে জরিমানা করার পর তার স্ত্রী রেলের একজন কর্মকর্তাকে টেলিফোন করে টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন।
স্ত্রীর এই কাজটি ঠিক হয়নি স্বীকার করে মন্ত্রী এও বলেছিলেন, ‘মাত্র ৯ মাস আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। নতুন যাকে আমি স্ত্রী হিসেবে নিলাম, আমাকে বুঝে উঠতে তারও সময় লাগবে।’
এত দ্রুত কীভাবে টিটিই শফিকুলকে বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হলো-এ প্রশ্নে তিনি জানান, ‘এটা নিয়ম মেনে করা হয়নি। সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ডিসিও (ডিভিশনাল কর্মাশিয়াল অফিসার)-কে শোকজ করা হয়েছে, সে এই অর্ডার কীভাবে দিলো।’
তুমুল আলোচিত একটি ঘটনার তদন্ত হলো আংশিক। বাকিটা কেন হলো না তা বুঝতে কিছু তথ্য ফের স্মরণ করতে হবে...
অতি উৎসাহী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা-ডিসিও নাসির উদ্দিন শুধু ত্বরিত গতিতে টিটিই শফিকুলকে বরখাস্ত করেই ক্ষান্ত হননি-তাকে দোষী প্রমাণ করতে নিজের ফোন থেকে সাংবাদিকদের কাছে লিখিত বিবৃতি পাঠিয়ে ওই যাত্রীদের সঙ্গে টিটিই শফিকুলের কথিত দুর্ব্যবহারের বিবরণ দিয়েছিলেন। বলার চেষ্টা করেছিলেন, শফিকুল মাদকাসক্ত, মানসিক রোগী, আগেও অপরাধ করেছিল-এক কথায় চরিত্র হনন।
শফিকুল তো এখন নির্দোষ প্রমাণিত হলেন, তাহলে তদন্তের আগেই তাকে দোষী প্রমাণের চেষ্টা করা ডিসিও নাসির উদ্দিন এবং টিটিই শফিকুলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগকারী মন্ত্রী পত্মীর ভাগ্নে ইমরুল কায়েসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা করছি।
এ আশা হয়তো পূরণ হবে না। কারণ তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানানোর সময় পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘বরখাস্তকারী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশের জবাব পেলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।’
প্রশ্ন হচ্ছে, তার জবাব পেলে যদি বিষয়টি আরও পরিষ্কার হতো তাহলে সেজন্য অপেক্ষা না করে জবাব পাওয়ার আগেই তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হলো কেন?
উত্তরটা খুব সহজ। টিটিই শফিকুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশদাতা এবং সে নির্দেশ পালনকারী কর্মকর্তাকে আড়াল করা। সেটা করতে হলে একজনকে বলির পাঁঠা বানাতে হয়, তিনি হলেন গার্ড শরিফুল। সরকারি তদন্ত নিয়ে মানুষের মধ্যে কেন অনাস্থা রয়েছে তা আরেকবার বোঝা গেল।
রেজোয়ান হক ।। বার্তা প্রধান, মাছরাঙা টিভি