ফিরে এলেন দুঃসাহসী নাবিক
স্মৃতিতে ভীষণ উজ্জ্বল দুটো দিন, একটি বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি, অপরটি একাশির ১৭ মে। দুটো দিনই ছিল নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, প্রেক্ষাপট ভিন্ন, অনুভূতি ভিন্ন।
প্রথমটিতে নিজস্ব ভুবনে ফিরেছিলেন ইতিহাসের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু আর প্রায় দশ বছর পর দ্বিতীয়টি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার শ্বাপদ-সংকুল স্বদেশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রত্যাবর্তন। অমোচনীয় কালিতে লেখা ইতিহাসের দিন দুটোর প্রেক্ষাপট, বাস্তবতা, আবেগ নিয়ে কিছু কথা বলে নিতে চাই।
বিজ্ঞাপন
একাত্তরে দীর্ঘ নয় মাস বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ডিসেম্বরের ষোল তারিখে বাঙালি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেছিল। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ত্রিশ লাখ শান্তিপ্রিয় মানুষের মিলিত রক্তস্রোতের মাধ্যমে বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল প্রিয় স্বাধীনতা।
পেয়েছিল চির শৃঙ্খলিত মাতৃভূমির হাজার বছরের প্রত্যাশিত মুক্তি। পেয়েছিল চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলকে ছায়া দেওয়া এক উজ্জ্বল মুক্ত আকাশ। অর্জিত হয়েছিল শতনদী বিধৌত সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা স্বাধীন স্বদেশভূমি-বাংলাদেশ।
মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, যুদ্ধের রণকৌশল শিখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পঁচিশে মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে যুদ্ধের নয়টি মাস বঙ্গবন্ধু ছিলেন বন্দি শিবিরে, শত্রু বাহিনীর কারাগারে। সুদূর পাকিস্তানের ভীতিকর কারাগারের একটি নির্জন প্রকোষ্ঠে।
অনৈতিক এবং অন্যায় শাস্তি মাথায় নিয়ে প্রিয় বঙ্গবন্ধু যদিও ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সীমানায়, কিন্তু তিনিই ছিলেন সমস্ত একাত্তরে প্রতিটি বাঙালির কাছে উজ্জ্বলতম বাতিঘর। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে তখন নিয়ত অনুরণিত হতো, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি...।’ অথবা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
যার নামে নয় মাস মরণ সাগর পাড়ি দিলো জাতি, তাকে ছাড়া স্বাধীনতা ঔজ্জ্বল্যবিহীন হবে সেটাতো স্বাভাবিক। কিন্তু সকল উৎকণ্ঠা আর শঙ্কা শেষে নেতা যেদিন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন সে দিন ছিল ১০ জানুয়ারি ১৯৭২।
বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স হয়ে ধানমন্ডির ৩২ অবধি উৎফুল্ল, আনন্দিত, গর্বিত বাঙালির মাঝে জানুয়ারির সেই দশ ছড়িয়েছিল আকাশ ভরা সূর্য-তারা আর বিশ্বভরা প্রাণের গৌরব ও সৌরভ। ধ্বংসস্তূপের মাঝেও বয়েছিল খুশির ফল্গুধারা।
জনারণ্যের দ্বিতীয় ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের দিনটিতে অর্থাৎ একাশির ১৭ মে তারিখে ছিল অন্যায়, অবিচার আর রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে লুণ্ঠিত সত্য, শুভ এবং সুন্দরকে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার।
জনারণ্যের দ্বিতীয় ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের দিনটিতে অর্থাৎ একাশির ১৭ মে তারিখে ছিল অন্যায়, অবিচার আর রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে লুণ্ঠিত সত্য, শুভ এবং সুন্দরকে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার।
পঁচাত্তরের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর গোটা দেশ চলে গিয়েছিল অন্ধকারে এবং বিভীষিকার নরককুণ্ডে। দুর্বৃত্তের অভয়ারণ্য যেন তখন বাংলাদেশ। কোলের শিশুটি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণে অত্যাচারীর ভয়ে শিউরে উঠতো।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র অর্জনগুলো বেয়োনেটের খোঁচায় ক্ষত-বিক্ষত করে উদ্ভট উটের পিঠে তখন চলছে দেশ। শ্বাপদ-সংকুল জনপদে দিন রাত কেবল হিস্ হিস্ শব্দ। হত্যাতঙ্কে কুঁকড়ে যাওয়া জনপদ যেন পাল ছেঁড়া হাল ভাঙা তরণীর লক্ষ্যহীন নিরুদ্দিষ্ট যাত্রা।
বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সঙ্গীরা পর্যন্ত হত্যাকারীর সাথে দোলনায় একসঙ্গে দোল খায়। কণ্ঠে পাক সার জমিন সাদ বাদের মতো পরিত্যক্ত ঘৃণ্য সুরের অনুরণন। সামরিক ছাউনিগুলোতে প্রতিদিন বেড়ে চলে মৃত্যুর মিছিল।
এক কথায়, বাংলাদেশ তখন হয়ে উঠেছিল পশু রাজ্যের চেয়েও ভীতিকর এবং আতঙ্কগ্রস্ত এক জনপদ। সেই ভীতিকর, অদ্ভুতুড়ে দেশে পরম পরিত্রাতা হিসেবে এবং উদ্ধারের কঠিন শপথ নিয়ে ফিরে এলেন, পঁচাত্তরের আগস্টে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা।
উত্তাল প্রকৃতি, রাজপথে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল, শামসুর রাহমান লিখলেন, ‘ইলেকট্রার গান’ শিরোনামে অসাধারণ এক কবিতা। আকাশের ঢল আর চোখের জলে একাকার শেখ হাসিনা বিশাল জনসমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে এসে দাঁড়ালেন বত্রিশ নম্বরের আবাল্য পরিচিত পূণ্যগৃহের দরজায়।
ভেতরের দেয়াল আর সিঁড়িতে তখনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। পিশাচ শাসকের নির্দেশে শেখ হাসিনাকে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো না। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। বুক ফাটা কান্না নিয়ে ধুলোময় রাজপথে বঙ্গবন্ধুর আদরের সন্তান-সে দৃশ্যের কথা মনে হলে আজও চোখ ভিজে আসে। কলম থেমে যায়, বাকরহিত হয়।
সেদিন শেখ হাসিনার আশ্রয়ের জন্য গোটা শহরে মাথার উপরে নিরাপদ ছাদ পর্যন্ত ছিল না। যেকোনো মুহূর্তে জীবননাশের ঝুঁকি। জনস্রোতের ভেতর ঘাপটি মেরে ছিল নীরব ঘাতকের দল। প্রকৃতির নিয়মে দিন শেষে সন্ধ্যা নামলো।
অভুক্ত, ক্লান্ত শেখ হাসিনার আশ্রয় মিলল লালমাটিয়ায়। নিকট আত্মীয়ের স্নেহময় স্পর্শে রাস্তায় রাতভর তরুণের দল, বঙ্গবন্ধু কন্যার নিরাপত্তায় যারা সেদিন জীবন বাজি রেখেছিলেন।
ভুলে গেলে চলবে না যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় তখন এমনই এক স্বৈরশাসক যার দুই চোখে ক্রুরতা এবং বুকে নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছুই নেই। শত সহস্র বাঙালি হত্যার রক্তের দাগ তার দুই হাতে একাত্তরের হত্যাকারীদের সাথে যার দহরম মহরম তার কাছে বঙ্গবন্ধু কন্যার জীবন যে নিরাপদ নয় সেই কথা আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।
তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, সকল বিপদকে তুচ্ছ জ্ঞানে পদদলিত করে দেশ, দেশের মানুষ, সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বিজয় রথ বলতে গেলে একাই টেনে নিয়ে চলেছেন ক্রমাগত।
এহেন মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা অসীম সাহসী শেখ হাসিনা দৃঢ় চিত্তে সেই যে যাত্রা শুরু করলেন তা রুখবার সাধ্য কারো হয়নি। চল্লিশেরও অধিক বছর একর পর এক পাহাড় সম বাঁধা অতিক্রম করে তিনি প্রমাণ করছেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর রক্তের যথার্থ উত্তরাধিকারী।
তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, সকল বিপদকে তুচ্ছ জ্ঞানে পদদলিত করে দেশ, দেশের মানুষ, সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বিজয় রথ বলতে গেলে একাই টেনে নিয়ে চলেছেন ক্রমাগত। সুদূরের পিয়াসী তিনি।
বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলা ভাষা, বাংলার ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে বিশ্বমাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় জীবন দর্শন এবং পবিত্র আদর্শকে পাথেয় করে শেখ হাসিনা আজ জননীর প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত।
স্মরণীয় যে বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের গভীরে ছিল মানব কল্যাণ। ছিল বাঙালির চিরায়ত ভ্রাতৃত্বর সংস্কৃতি। যে আবহমান সংস্কৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো অসাম্প্রদায়িকতা। সম্প্রীতির পবিত্র পীযূষ ধারায় স্নাত ছিল বঙ্গবন্ধু মজিবের চিত্ত।
একইভাবে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত মৃত্তিকা সংলগ্ন সম্প্রীতির পুণ্য দর্শনে শতভাগ নিষ্ঠ শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছিলেন বলে আজও দেশের হাজার হাজার মন্দিরে সরবে সর্বানন্দে শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়।
বৌদ্ধ পূর্ণিমা এবং যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন বড়দিনের উৎসব পালিত হয় সাড়ম্বরে। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কত যে উৎসব পাহাড়ে এবং সমতলে রঙধনুর রঙ ছড়ায়।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা রাষ্ট্র-সরকার-রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতির নেতৃত্বে না থাকলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি কবেই মানবতা রহিত, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক বন্যদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতো। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে এক নাগারে প্রায় দুই যুগের নিয়ন্ত্রকদের আচরণ এবং কর্মকাণ্ড সেটাই বলে না কি!
তবুও উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এখনো সুযোগ সন্ধানী হয়ে দেশ ও সমাজে সম্প্রীতি বিনষ্টের পাঁয়তারা করে মাঝে মাঝেই। নানামুখী অপকৌশল এবং সুচতুর ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার বছরের সংস্কৃতির উপর আঘাত যে আজও হয় না তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রতিটি অঘটনে সবার আগে দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, প্রশাসন এবং সমাজের শুভবাদী মানুষদের সাথে নিয়ে প্রতিবাদের নেতৃত্বে থাকেন শেখ হাসিনা।
তিনিই তখন হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রিত সম্প্রীতির বাংলাদেশের রক্ষাকবচ। তাই বলছিলাম দীর্ঘ ছয় বছর কষ্টের প্রবাস জীবন থেকে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে যদি তিনি না ফিরতেন তবে কি আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ টিকে থাকতো! তবে কি আর আমরা গাইতে পারতাম ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালী।’
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ।। আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ