বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যাবর্তন দিবসে
১৭ মে ১৯৮১। এই দিনে স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট বাংলাদেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ তখন বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হারিয়ে ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মাটিতে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু তার ‘সোনার বাংলা’র আজন্ম লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যে অতুলনীয় অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ তাকে হত্যা করে সে অভিযাত্রাকে থমকে দিয়েছিল বিশ্বাসঘাতকেরা।
মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু ‘যুদ্ধের ছাই-ভস্ম থেকে সমৃদ্ধির পথে’ দেশকে যে গতিতে এগিয়ে নিচ্ছিলেন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর দেশ ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে’ চলতে শুরু করেছিল তার বিপরীত দিকে। তবে শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হারালেও, তিনি আমাদের চিন্তায় চেতনায় জাগরূক হয়ে ছিলেন। তাই ১৯৮১-তে বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন ফিরে এলেন তখন আমরা নতুন করে দেশকে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম।
বিজ্ঞাপন
লড়াই করে শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার যে মানসিকতা বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে প্রোথিত করে দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা তাকে আরও দৃঢ় করেছিলেন। দেশকে স্বৈরশাসনের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে কত ত্যাগই না তাকে শিকার করতে হয়েছে!
বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও পিছ পা হননি কখনো। বহু সংগ্রামের পর ১৯৯৬-এ প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন তিনি। দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ভাবনার আলোকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন নতুন উদ্যমে।
২০০১-এ দেশি-বিদেশি চক্রান্তে সেই সোনালি অভিযাত্রায় আবারও ছেদ পড়ে। এরপর আবার তার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়, তাকে কারাবন্দি করে দমন করার চেষ্টা হয়। কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের প্রশ্নে চির-আপসহীন বঙ্গবন্ধুকন্যা ঠিকই এই বিপুল বাধা আর চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আবার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। সেই থেকে পরের এক যুগেরও বেশি সময়ে তার অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই আর গণমুখী নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়েছে।
বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও পিছ পা হননি কখনো। বহু সংগ্রামের পর ১৯৯৬-এ প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন তিনি। দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ভাবনার আলোকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন নতুন উদ্যমে।
১৯৮১-তে বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে উদযাপন করে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, ‘আপনার প্রত্যাবর্তন আজ শেষ হয়নি।’ আজ এই কথাটি বেশি করে মনে পড়ছে। কারণ বঙ্গবন্ধুকন্যার সংগ্রাম সত্যিই আজও শেষ হয়নি। এক যুগের বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে বৃহত্তর জনস্বার্থের প্রতি আপসহীন থেকে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
একটি শক্তিশালী আর্থসামাজিক ভিত্তির ওপর দেশকে দাঁড় করাতে পেরেছেন বলেই করোনা মহামারির স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আর এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অন্য অধিকাংশ দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো করেছে।
৮০ ভাগ নাগরিকের জন্য করোনা টিকার ব্যবস্থা করে, ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প রক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি প্রণোদনা দিয়ে সবে মাত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বেগবান করে সবাইকে আশার আলো দেখাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এর মধ্যেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শুরু হয়েছে নতুন সঙ্কট।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, বৈশ্বিক খাদ্য সংকট, রপ্তানির বাজার নিয়ে আশঙ্কা ইত্যাদি তো রয়েছেই। এসবের জেরে দেশের ভেতরে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে কম আয়ের মানুষের বিপদ নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। আরও আছে ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যা-আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমরা নিশ্চিত বরাবরের মতো এইসব চ্যালেঞ্জও তিনি সফলভাবে মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারাকে বেগবান রাখতে সক্ষম হবেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের ওপর এহেন আস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এ প্রসঙ্গে কবি সুফিয়া কামাল যথার্থই লিখেছিলেন, ‘...শেখ হাসিনা মৃত্যুর ভয়ে পশ্চাৎপদ হননি। সাহসের সাথে সংগ্রামে এগিয়ে অগ্রবর্তিনী হয়ে আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।’ (আলী হাবিব সম্পাদিত ‘তিমির হননের নেত্রী, ২০১৮, ‘সুফিয়া কামালের প্রার্থনা : শেখ হাসিনার জন্য, পৃষ্ঠা-৯)।
সত্যিই তাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তেরো বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর স্বপ্ন দেখিয়ে। সেভাবে নীতি গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়নও তিনি করেছেন।
১৯৭৫-এ মাথাপিছু আয় ছিল ২৭৮ ডলার। এখন তা দুই হাজার আটশো ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই উল্লম্ফনের ৭৩ শতাংশই কিন্তু হয়েছে শেষ বারো বছরে। করেনাকাল কাটিয়ে ফের অর্থনীতি সাত শতাংশের বেশি হারে বাড়তে শুরু করেছে। তবে বৈষম্যও বাড়ন্ত। সেজন্যই কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষার ওপর জোর দিতে কার্পণ্য করছেন না বঙ্গবন্ধুকন্যা।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, বৈশ্বিক খাদ্য সংকট, রপ্তানির বাজার নিয়ে আশঙ্কা ইত্যাদি তো রয়েছেই। এসবের জেরে দেশের ভেতরে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে কম আয়ের মানুষের বিপদ নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। আরও আছে ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যা-আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ।
এসবের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। তবে মনে রাখা দরকার এটি এখন বিশ্ব সঙ্কটে রূপ নিয়েছে। তাই নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তার কথা স্বদেশী কায়দায় ভাবতে হবে। এখনো মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ কৃষি খাতেই নিযুক্ত আছে। সরকারও তাই কৃষির দিকে নীতি-মনোযোগ অব্যাহত রেখেছে।
উন্নয়নের প্রধানতম সূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্তি। বাংলাদেশে এখন প্রায় সব পরিবারই বিদ্যুৎ পাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর ফলে বিনিয়োগ পরিবেশেরও উন্নতি হয়েছে। এর পাশাপাশি বিডাসহ রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালা সহজীকরণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যথেষ্ট সক্রিয়তা দেখাচ্ছে। এর পেছনেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নৈতিক সমর্থন বেশ স্পষ্ট।
এছাড়াও পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কর্ণফুলী টানেলসহ বিপুল সংখ্যক এমন মেগাপ্রকল্প তিনি বাস্তবায়ন করেছেন যেগুলো কর্মসংস্থানসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক শক্তির বিকাশে ‘মেগাচেঞ্জ’ হতে পারে। একইসঙ্গে দ্রুত উৎপাদনশীল হবে না এমন বৃহৎ প্রকল্প না গ্রহণ করার বিষয়ে তার নির্দেশনা বিদ্যমান বাস্তবতা সম্পর্কে তার সংবেদনশীলতাই প্রমাণ করে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর জীবনঘন শিক্ষাদর্শনকে মূল জায়গায় রেখে বিগত এক দশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরলসভাবে কাজ করেছেন। গুণ-মানের অপূর্ণতা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার শিক্ষার বিস্তারে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাই শুরু থেকেই এ বিষয়ে সচেতন থেকেছেন। বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ তার প্রমাণ।
সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার যে ঐতিহ্য স্থাপন করে গেছেন বঙ্গবন্ধু, তাকে সজোরে আঁকড়ে ধরেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা। বঙ্গবন্ধু যেমন করে করে শিখেছেন, দুঃখের বন্ধনকে শক্তিতে রূপান্তর করেছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যাও ঠিক তেমনি অতীত-বর্তমানের মধ্যে নিরন্তর ‘চিত্তের সম্বন্ধ’ (রবীন্দ্রনাথ) বজায় রেখেই এগিয়ে চলেছেন স্বদেশের দ্রুত রূপান্তরের পথরেখা ধরে।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘সমাজের নীচ হইতে উপর পর্যন্ত সকলকে একটি বৃহৎ নিঃস্বার্থ কল্যাণ বন্ধনে বাঁধা, ইহাই আমাদের সকল চেষ্টার অপেক্ষা বড়ো চেষ্টার বিষয়।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা সমাজের সকল অংশীজনকে ‘নিঃস্বার্থ কল্যাণ বন্ধনে’ আবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে সঙ্কট মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবেন এই আস্থা আমাদের রয়েছে।
ড. আতিউর রহমান ।। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর