আইজিপি হিসেবে দুই বছর
ড. বেনজীর আহমেদ : প্রমিথিউস অব পুলিশিং
বাংলাদেশ পুলিশ মানুষের আগ্রহ ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের আইজিপি হিসেবে ড. বেনজীর আহমেদ ইতোমধ্যেই দুই বছর পূর্ণ করে তৃতীয় বছরে পদার্পন করেছেন। পুলিশের প্রত্যাশা পূরণে ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে একবিংশ শতাব্দীর জন্য সমৃদ্ধ করতে এ দুই বছরে ড. আহমেদ নানাবিধ দৃশ্যমান পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নিয়েছেন, যা অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে কিছু সমালোচনা স্বত্বেও ড. আহমেদ দুর্দান্ত গতিতে এগিয়েছেন, এগিয়েছেন প্রজ্ঞার সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে। আধুনিক পুলিশ প্রশিক্ষণ, স্বচ্ছ ও মেধানির্ভর নিয়োগ, বিট পুলিশিং ও আউটরিচ কার্যক্রমের জন্য অনেকের কাছে তিনি ‘প্রমিথিউস অব পুলিশিং’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিগণিত হয়েছেন। এ লেখা তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পুলিশের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের কিয়দাংশের নির্মোহ বিশ্লেষণের একটি নিতান্ত ক্ষুদ্র প্রচেষ্ঠা।
পুলিশের প্রশিক্ষণের আধুনিকায়ন
বিজ্ঞাপন
ড. বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের সব সদস্যদের জন্য প্রতিবছর একক ও সম্মিলিত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন, ব্যাপক পরিবর্তন এনে প্রশিক্ষণ কারিকুলামকে করেছেন যুগোপযুগী ও ভবিষ্যতমুখী। সাধারণভাবে ক্যাডার অফিসাররা চাকরির শুরুতে পুলিশের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষ করার পর অনেক উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিলেও মৌলিক প্রশিক্ষণ বাস্তবিক অর্থে আর ঝালাই করার কাঠামোগতভাবেই কোনো সুযোগ পেতেন না। তারই নির্মোহ উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায় প্রতিবছর কমপক্ষে এক সপ্তাহ করে সব সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে পেশাদারিত্বে নিয়ে এসেছেন এক অনন্য পরিবীক্ষণ। দ্বিতীয়ত, উপনিবেশিক কালের পরিক্রমায় এতদিন পুলিশের বিভিন্ন স্তরের প্রশিক্ষণের কারিকুলাম ও সিলেবাস চলছিল, তা তিনি সবার মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন করে ঢেলে সাজিয়েছেন কালের যাত্রায় আগামীর আলোয়। যেমন সংযোজন করেছেন বাস্তবমুখী ব্যবহারিক প্রবলেম সলভিং ইস্যুজ, তেমনি অনাগত দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়গুলো।
স্বচ্ছ, মেধা ও যোগ্যতা নির্ভর পুলিশ নিয়োগ
ড. বেনজীর আহমেদের এ দুই বছরে বাংলাদেশ পুলিশের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্তরে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে তা সদাশয় সরকার থেকে প্রান্তের সর্বস্তরের নাগরিকদের কাছে সফল, স্বচ্ছ, মেধাভিত্তিক ও দক্ষ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এ উপমহাদেশে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক কথামালার প্রচলন আছে। সেসব নেতিবাচকতাকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কনস্টেবল, সাব-ইন্সপেক্টর ও সার্জেন্ট নিয়োগে যে স্বচ্ছতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে, তা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয় ও প্রশংসার দাবিদার। মেধা, যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, বিশেষ ব্যবহারিক উপযোগিতা ও শারীরিক সক্ষমতার মাপকাঠিতে যথার্থভাবে নিরূপিত উত্তীর্ণ প্রান্তিক প্রার্থী ও তাদের অভিভাবকদের যে নির্মোহ উচ্ছ্বাস, তা এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে দেয়, গর্বে হৃদপিন্ডকে প্রসারিত করে। দেশমাতৃকার সেবায় নিবেদিত হয়ে কাজের যে নিরন্তন প্রয়াস, তার প্রেরণা আসে নিয়োগ বিজ্ঞাপনের সরকারি ট্যাগ লাইন থেকেই ‘চাকরি নয়, সেবা’।
বিট পুলিশিং : নাগরিকের দোরগোড়ায় সেবা
নাগরিকের দোরগোড়ায় কতিপয় পুলিশি সেবাকে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে শুরু থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন ড. আহমেদ। সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, তা অনেকেই অবহিত। একসময় যখন নিউইয়র্ক সিটির অলিতে গলিতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই আর মাদকের করাল গ্রাসে সাধারণ নাগরিকের জীবন ত্রাহীত্রাহী অবস্থায় হাবুডুবু খাচ্ছিল, ঠিক তখনই নিউইয়র্ক পুলিশের হাল ধরেছিলেন উইলিয়াম ব্রাটন। পুরো সিটিকে তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বা বিটে ভাগ করে একেকজন পুলিশ অফিসার নিয়োগ করে ব্যাপকভাবে সফল হয়েছিলেন নিউইয়র্কের পুলিশ কমিশনার ব্রাটন। সেই সফলতার গল্প তিনি বিধৃত করেছেন ‘টার্ন অ্যারাউন্ড : হাউ আমেরিকানস টপ কপ রিভার্সড দ্য ক্রাইম এপিডেমিক’ গ্রন্থে। সেই ধারনায় কিছুটা প্রভাবিত হয়ে ড. বেনজীর আহমেদ ডিএমপি কমিশনার থাকাকালীন ঢাকা সিটিতে প্রবর্তন করেন বিট পুলিশিং কার্যক্রম। পরে আইজিপি হয়ে সারাদেশে নাগরিকদের দোরগোড়ায় পুলিশি সেবাকে নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সদয় অনুমতিতে চালু করেন বিট পুলিশিংয়ের অভিযাত্রা। বাংলাদেশকে প্রায় আট হাজার বিটে ভাগ করে প্রত্যেক বিটে একজন করে পুলিশ অফিসারকে দায়িত্ব দেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের সহায়তায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ হয় বিট পুলিশিংয়ের জন্য একটি কক্ষ। দায়িত্ব ও দায়ের এ অসাধারণ বিভাজন ও বিকেন্দ্রীকরণ প্রায় দেড়শ বছরের বেশি সময়ে যে পুলিশ, তার ক্রমধারায় একটি অনন্য ও আধুনিক মাইলফলক। অনাগত সময়ে নিউইয়র্কের মতোই বাংলাদেশের মানুষ পুলিশিং কার্যক্রমে ইতিবাচক আলোকোজ্জ্বল সেবা পাবেন বলে আমি আশাবাদী।
পুলিশের সম্প্রসারণ ও সংযোগ কার্যক্রম
বাংলাদেশ পুলিশের কাজ, জনবল ও অবকাঠামোগত আনুভূমিক সম্প্রসারণ হলেও, অফিসার ও ফোর্সের আনুপাতিক বিভাজন ও সম্প্রসারণ নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল। ড. বেনজীর আহমেদ যেহেতু অর্গানাইজেশনাল চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট নিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ও জাতিসংঘের পুলিশ রিফর্ম নিয়ে এই উপমহাদেশে থেকে একমাত্র এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করেছেন, সেসব অমূল্য অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের পদ-পদবির সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন, যার ফলশ্রুতিতে ইতোমধ্যেই অনেকেই বহুল কাঙ্ক্ষিত পদন্নোতির পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর পুলিশের সংগঠন আসিয়ানাপোলে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা আনয়ন তার সেই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশ পুলিশের আধুনিকায়ন নিঃসন্দেহে একটি ব্যাপক আলোচনার বিষয় ও দীর্ঘতর চলমান প্রক্রিয়া। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত ও তারই তনয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শনের এক নির্ভীক সৈনিক হিসেবে বিগত দুই বছর ড. বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের যে স্বাপ্নিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব দিয়েছেন নিঃসন্দেহে তা ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে, ইতোমধ্যেই তিনি অনেক পুলিশ অফিসারের কাছে ‘প্রমিথিউস অব পুলিশিং’ হিসেবে অভিহিত হয়েছেন। যেকোনো নেতৃত্বে অগনিত চ্যালেঞ্জ থাকে, তার ক্ষেত্রেও নিশ্চয় ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘এসেছি অনেক দূর, যেতে হবে বহুদূর’-তারই কথার প্রতিধ্বনি করে, আমরা প্রত্যাশা করি আগামী দিনগুলোতেও টেকসই উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অভিযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাগরিকদের ঐতিহাসিকভাবে কাঙ্ক্ষিত ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ পুলিশকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি নিয়ে যাবেন আরো বহুদূর।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্র্যাকটিসিং ল'ইয়ার।
জেডএস