ঈদ ও উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে অনলাইন ব্যবসার প্রসার
বাঙালি জাতিসত্তার শেকড়ের সাথে মিশে আছে নানারকম উৎসবমুখর কার্যক্রম। হোক বৈশাখী মেলা কিংবা নবান্ন উৎসব। হোক পাহাড়িদের বিজু উৎসব কিংবা কৃষকের নবান্ন। এমনকি ঈদ মেলা থেকে দোল পূর্ণিমা কোনো কিছুতেই উৎসবের কমতি নেই।
এসব উৎসবে বাড়তি আয়োজন থাকে। সেটা খাবারে, পোশাকে কিংবা অতিথি আপ্যায়নে। বাড়তি আয়োজন মানেই বাড়তি অর্থনৈতিক লেনদেন। আমাদের দেশে ঈদের জামাতকে কেন্দ্র করে যে ঈদমেলা বসে। কয়েক ঘণ্টার সে পসরাতেও থাকে বিশাল আর্থিক লেনদেনের চিত্র। এই সংস্কৃতি বা চর্চা এখন অনলাইনে স্থানান্তরিত হয়েছে। নতুন স্বাদের খাবারের স্বাদ নেওয়া, নতুন মডেলের ডিজিটাল ডিভাইস, নতুন রুচির পোশাকের বিকিকিনির সবকিছুই হয় অনলাইনে।
বিজ্ঞাপন
যদিও এখনো মাত্র ৫% (ক্ষেত্রবিশেষে একটু বেশি) ক্রেতা অনলাইনে কেনাকাটা করে থাকে। দেশের ইন্টারনেট ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করলে এরচেয়ে ছয়গুণ মানুষের অনলাইনে কেনাকাটার সুযোগ রয়েছে। অনলাইন ব্যবসা ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। একে আরও নিরাপদ, পেশাদার ও জনপ্রিয় করার জন্য আমরা কাজ করছি।
বিগত বছরসমূহে আমরা লক্ষ্য করেছি অনলাইন কেনাকাটা ঈদের সময়ে বৃদ্ধি পায়। রমজান মাসের লেনদেন তার আগের মাসের লেনদেনের থেকে ৫০% বেশি থাকে। বর্তমানে সারাদেশে প্রতিদিন ডেলিভারির পরিমাণ ৩ লক্ষের মতো।
ঈদকে কেন্দ্র করে এই ডেলিভারির সংখ্যা সাড়ে ৪ লক্ষ্যে পৌঁছে। প্রতিটি ডেলিভারির বাস্কেটভ্যালু ২১৫০ টাকা থেকে ২২শ টাকা ছিল। ঈদে বাস্কেটভ্যালু গড়ে ২৫শ টাকা হবে। সাধারণত পোশাকের ক্ষেত্রে বাস্কেটভ্যালু আরও কম হলেও গেজেটের কারণে এর গড় ভ্যালু বেড়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রায় বড় এবং নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো অনলাইন শপ চালু করেছে। এটা একেবারেই নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এতে একদিকে ক্রেতাদের আস্থা থাকে বিধায় ক্রেতারা বিনা সংকোচে ব্র্যান্ডশপগুলোর অনলাইন আউটলেট থেকে পণ্য ক্রয় করেন। অন্যদিকে এসব পণ্যের দাম একটু বেশি থাকে বিশেষ করে ফেসবুক উদ্যোক্তাদের পণ্যের তুলনায়।
আবার এখানে ক্যাশ অন ডেলিভারির তুলনায় কার্ডে লেনদেন হয়। ভিসা ও মাস্টারকার্ডের ডেবিট ক্রেডিট কার্ড লেনদেনের পরিমাণ বেশ উল্লেখযোগ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রায় বড় এবং নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো অনলাইন শপ চালু করেছে। এটা একেবারেই নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এতে একদিকে ক্রেতাদের আস্থা থাকে বিধায় ক্রেতারা বিনা সংকোচে ব্র্যান্ডশপগুলোর অনলাইন আউটলেট থেকে পণ্য ক্রয় করেন।
কিছু কিছু ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে উৎসবকেন্দ্রিক অনলাইন বাজারে অবদান রাখে। আমরা যার কিছু বিষয়ের সঠিক হিসাব পাই না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও নারী উদ্যোক্তারা কিন্তু এই সময়ে বড় ধরনের লেনদেন করে থাকে। এর বেশিরভাগ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হয়ে থাকে এবং অনেকক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং-এর ব্যক্তিগত হিসাবে হয়ে থাকে তাই এ সম্পর্কে প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না।
আমাদের ধারণা বর্তমান সাড়ে চার লাখ ডেলিভারির মধ্যে ২ লাখই ফেসবুক উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে যদিও তাদের বাস্কেটভ্যালু ১৫শ টাকার মতো।
আমরা শিক্ষিত মানুষেরা অনলাইনে থাকি বলে আমাদের কাছে মনে হয় সব বেচাকেনা বুঝি অনলাইনে হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন নয়। তবে অন্য যেকোনো ব্যবসার তুলনায় এর প্রবৃদ্ধি বেশি এতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থান হয়।
কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে বিগত বছর অনলাইন লেনদেন কিছুটা হোঁচট খায়। মোট ই-কমার্স লেনদেনের মাত্র ৫% অনলাইনে সম্পাদিত হতো ২০১৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে এই হার ৩০% পর্যন্ত উন্নীত হয়। পরে গুটিকয়েক বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায়িক আচরণের কারণে এটা ১০% নেমে এলেও বর্তমানে এটাও উঠতির দিকে রয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এবারের ঈদে ২ হাজার ২শ থেকে ২ হাজার ৫শ কোটি টাকার অনলাইন ব্যবসা হবে। যার কিছু অংশ অনলাইনে পেমেন্ট হবে আরও বেশিরভাগ হবে সিওডিতে। আমরা জানি গত বছর ঈদ-উল-আযহাতে অনলাইনে ৩ লক্ষ ৮৭ হাজার পশু বিক্রি হয়েছে যার মূল্য ২ হাজার ৭শ কোটি টাকা এই ক্ষেত্রে অনলাইন পেমেন্টের পরিমাণ ১% এর কম।
আমরা শিক্ষিত মানুষেরা অনলাইনে থাকি বলে আমাদের কাছে মনে হয় সব বেচাকেনা বুঝি অনলাইনে হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন নয়। তবে অন্য যেকোনো ব্যবসার তুলনায় এর প্রবৃদ্ধি বেশি এতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থান হয়।
আবার ঈদের পোশাক বিক্রির ক্ষেত্রে অনলাইন লেনদেন প্রায় ২০%। এক্ষেত্রে গ্রাম থেকে আসা অর্ডারের সংখ্যা ২৩% এর মতো। সারাদেশে অনলাইন বিক্রির ৫০% ঢাকায় হয়ে থাকে।
আমরা বৃহৎ কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ডাটা নিয়ে এই বিশ্লেষণগুলো করে থাকি এর মধ্যে রয়েছে ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস ও ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এখানে কোনো শৃঙ্খলাযুক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জরিপ ও গবেষণা করা গেলে আরও যথাযথ তথ্য পাওয়া যেত।
যাই হোক, আমাদের উৎসব, পার্বণ আর অর্থনীতি একই সমান্তরালে না থাকলেও একসূত্রে গাঁথা। এটা বোঝার জন্য একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে এটা যে, আমাদের সব আয়োজনে খাবার থাকে। হোক সেটা আনন্দ উৎসব কিংবা শোকপর্ব। এবং আত্মীয় স্বজনের জন্য উপহার দিতে হয় এটা জন্মের উপলক্ষে যেমন হয় তেমনি মৃত্যুর কারণেও হয়।
তাই উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক লেনদেনে এই ধারা ক্রমশ ডিজিটাল হয়ে উঠবে সেরকম লক্ষণই আমরা দেখতে পাচ্ছি।
নাসিমা আক্তার নিশা ।। প্রেসিডেন্ট, ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)
nishabd2012@gmail.com