ছবি : সংগৃহীত

‘বৈষম্য বিরোধী আইন, ২০২২’ নামক একটি বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে এবং এটি কমিটিতে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। বিলের ওপর দুটি সংগঠন আলোচনাও করেছে। কিন্তু যে দ্রুত গতিতে সরকার আগাচ্ছে তাতে নাগরিকদের এই বিলের ওপর আলোচনার সুযোগ দেবে বলে মনে হচ্ছে না। এই বিলের অসাংবিধানিক এবং ন্যায়বিচার পরিপন্থী কিছু বিষয় আমাদের জানা দরকার।

আইনের কতিপয় ধারা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, দেশের মানবাধিকার এবং সাংবিধানিক অনেক বিষয় সরকার নিজ হাতে তুলে নিতে চাচ্ছে এই আইনের মাধ্যমে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এই বিল সংসদে পাশ হলে বৈষম্য কেবল বাড়বেই না; সমতা এবং বৈষম্যের যে সকল নীতি বা রক্ষাকবচ আছে সেগুলোকেও জীবন্ত কবর দেওয়া হবে।

১. এই বিলটিতে আলাদা বৈষম্য বিলোপ স্বাধীন কমিশন করা হয়নি। আইনের ৪ ধারায় মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে যেখানে ৯০% সরকারি মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়ন্ত্রণ করবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৈষম্য বিলোপ স্বাধীন কমিশন থাকে যারা সরকারের বিরুদ্ধে নাগরিকদের বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখে। বর্তমান বিলে স্বাধীন কোনো কর্তৃপক্ষ গঠন না করে সরকারি কৰ্তৃপক্ষকেই বিচারক বানানো হয়েছে যার পরিণতি মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে।

২. ৪ ধারায় আরও বিধান করা হয়েছে যে, বৈষম্য বিরোধী মনিটরিং কমিটি জাতীয় কমিটি, জেলা কমিটি এবং বিভাগীয় কমিটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

পুরো বিলটিতে দেখা যায় যে, চারটা সরকারি কর্তৃপক্ষ অতিক্রম করে তারপর আদালতের কাছে যেতে পারবে একজন নাগরিক। বিষয়টা একজন ভুক্তভোগী নাগরিকদের জন্য কতটা হয়রানিমূলক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

৩. ৬ ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, বৈষম্য বিরোধী একটা সেল থাকবে যা সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। এই সেলের কর্তৃপক্ষ দেশের যেকোনো স্থানে কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে।

আইনের সার্বিক বাস্তবায়ন করবে এই সেল। সরকারের একটা মন্ত্রণালয় বৈষম্য বিরোধী অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে। বিষয়টা কতখানি সাংঘর্ষিক তা সহজেই অনুমেয়। বৈষম্যমূলক কাজ এবং আচরণ করে মূলত সরকারের লোক এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ। সেই সরকারই আবার বৈষম্যের বিচার করবে! বাস্তবে বিষয়টা বিচারের নামে একধরনের প্রহসন হবে বলে মনে হচ্ছে।

৪. ৭ ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, বৈষম্য বিরোধী জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা এবং স্থানীয় কমিটি থাকবে।

৫. ৯ ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, কোনো বৈষম্য মূলক কাজ সংগঠিত হলে ভুক্তভোগী জেলা কমিটির নিকট অভিযোগ করতে পারবেন। বিল থেকে পুরাপুরি ধারণা করা যায় যে, জেলা কমিটির প্রধান ডেপুটি কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়া হবে।

যে ডিসি বা এডিসি বা থানা নির্বাহী অফিসার সবচেয়ে বেশি বৈষম্যমূলক কাজ করে, তারাই আবার বৈষম্যের বিচার করবে। বিষয়টি কতখানি মানুষের মৌলিক অধিকার এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী তা বোঝা যায়।

৬. ৯(২) উপ-ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, অভিযোগ পাওয়ার পর জেলা কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত করবে। এই তদন্ত তারা পুলিশের মাধ্যমেই করবে।

১১ ধারায় এমন বিধান করা হয়েছে। এই তদন্ত কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হবে এমনটি ভাবার অবকাশ দেখা যাচ্ছে না। সমস্যা হলো, যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে বৈষম্যের জন্য প্রতিকার চাওয়া হবে সেই প্রশাসনই বৈষম্যের বিচার করবে। বিষয়টা পুরোপুরি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

৭. জেলা কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত আলোচনা করে ব্যর্থ হলে ভুক্তভোগী ৩০ দিনের মধ্যে বিভাগীয় কমিটির নিকট দ্বিতীয়বার অভিযোগ করতে পারবে। বিভাগীয় কমিটি আবার ৩০ দিনের মধ্যে একই বিষয় তদন্ত করবে। তদন্তের পর বিভাগীয় কমিটি কী করবে তার কিছুই আইনে বলা হয়নি।

৮. বিভাগীয় কমিটি প্রতিকার প্রধানে অক্ষম হলে ভুক্তভোগী জাতীয় কমিটিতে অভিযোগ করতে পারবে। জাতীয় কমিটি আবার ৪৫ দিনের মধ্যে তৃতীয়বার তদন্ত করবে। একই বিষয়ের ওপর তিনবার তদন্ত- বিষয়টা কতটা হয়রানিমূলক নাগরিকের জন্য কষ্ট বয়ে আনতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া জাতীয় কমিটির বৈঠক কোথায় হবে তাও পরিষ্কার না। জাতীয় কমিটি কীভাবে এবং কী ধরনের প্রতিকার দেবে তা পুরোটাই অস্বচ্ছ।

৯. ৯(৬) উপধারায় বিধান করা হয়েছে যে, জাতীয় কমিটি প্রতিকার দিতে ব্যর্থ হলে ভুক্তভোগী উপযুক্ত আদালতে মামলা করতে পারবে। উপযুক্ত আদালত বলতে কোন আদালতকে বোঝানো হলো তা কোনোভাবেই পরিষ্কার না।

১০. ১০ ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, আদালতে মামলা দায়ের হলে আদালত ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করবে। অনেক অস্বচ্ছ এবং ন্যায়বিচার পরিপন্থী এই ১০ ধারার বিধান। আদালত কীসের বিচার করবে? অপরাধ? কীসের অপরাধ?

একই অপরাধের জন্য তিনবার তদন্ত। সেই তদন্ত প্রতিবেদনগুলো ভিন্ন ভিন্ন হলে আদালত কীভাবে বিচার করবে? আদালত কি কাউকে শাস্তি দিতে পারবে? কীভাবে? এই আইন কি ফৌজদারি আইন নাকি মানবাধিকার সংক্রান্ত আইন? আদালত আদেশ এবং প্রয়োজনে জরিমানা করতে পারবে। জরিমানার টাকা সরকারের তহবিলে জমা হবে। ভুক্তভোগী কী পাবে?

১১. ৩ ধারায় বৈষম্যমূলক কার্যের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার সবগুলোই সংবিধানে সুরক্ষিত মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ দিতে পারে। কিন্তু বৈষম্যমূলক মৌলিক অধিকারগুলো প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিয়ে বিচার বা তদন্ত করার অর্থ হবে এই মৌলিক অধিকারগুলোকে জীবন্ত কবর দেওয়া।

দেশের ক্রমাগত বেড়ে ওঠা জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে উচ্চ আদালতে মামলার সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক সুযোগ পেলেই বলে ফেলে ‘আইনে যে প্রতিকার আছে সেটা সম্পন্ন করে তারপর আমাদের কাছে আসুন।’ বৈষম্য বিরোধী আইন সংসদে পাস হলে মানবাধিকারের চরম বিপর্যয় হবে বলে ধারণা করা যায়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজ হলো মানবাধিকারের লঙ্ঘন হতে পারে এমন কোনো আইনের বা বিলের পর্যালোচনা করে সুপারিশ করা। কমিশনকে গত দশ বছরে সেরকম বলিষ্ঠ ভূমিকায় আমরা দেখতে পাইনি। এই আইন সংসদে পাস হলে এটি হবে আর একটি অসাংবিধানিক কালো আইন।

আইনের বিভিন্ন কালো দিক নিয়ে ব্লাস্ট এবং নাগরিক পর্যালোচনা করেছে এবং তারা আইনের কালো দিকগুলো তুলে ধরে বাছাই কমিটির নিকট সুপারিশ প্রেরণ করবে বলে আশা রাখি।

ব্যারিস্টার মো.আব্দুল হালিম ।। আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট