হাওরের কৃষক : ডোবে ঋণে, সুদে
মানুষ কতটা অসভ্য সে কথা জানে প্রকৃতি। বৃক্ষ, জল দুইয়েরই জানা কতটা দানব হয়ে উঠেছে মানুষ। প্রকৃতির সঙ্গে থেকে, প্রকৃতির অংশ হয়েও মানুষ বড় শত্রু প্রকৃতির। যেকোনো সম্পর্কের মাঝে বোঝাপড়া থাকে। দরকার হয় ভালোবাসার।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের, বিশেষ করে এই ব-দ্বীপের মানুষের মধ্যে যেটুকু বোঝাপড়া ছিল, তা এখন প্রায় নিঃশেষ। ফলে প্রকৃতিকে ধ্বংস বা হত্যা করার যেকোনো সিদ্ধান্ত মানুষ মুহূর্তেই নিতে পারে।
বিজ্ঞাপন
ধরিত্রীতে বসবাসের যে একটি জীবন চক্র আছে, ভারসাম্য রক্ষার সূত্র আছে, এগুলো মানুষ তোয়াক্কা করছে না। ফলে বৃক্ষ ও জল হত্যা মানুষের এক বীভৎস খেলায় রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ নামের ব-দ্বীপটি তো সজ্জিত ছিল প্রকৃতির অপরূপ অলংকারে। সবুজ জমিনের ওপর জলের বুনন। সেই নকশিকাঁথা এখন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন এখানকার মানুষের লোভের আঁচড়ে।
মানুষ প্রকৃতির কাছে আনন্দ খোঁজে। সেই আনন্দ একতরফা লুটেপুটে নেওয়ার আনন্দ। অপর পক্ষ যে বিপন্ন, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে একথা মানুষ ভাবে না। এমনকি পরবর্তী জন বা মানুষের জন্যেও যে প্রকৃতির সুন্দর বা সম্পদ টিকিয়ে রাখা দরকার, সেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতাও তৈরি হয়নি। সেজন্যই বন উজাড় করতে, বন্য প্রাণী হত্যা করতে, নদী খুন করছে মানুষ সহজ ভাবে।
হাওরের অকাল বন্যা, বাঁধ ভাঙা পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার জন্য এমন শিশুসুলভ অবকাঠামো নির্মাণকে দায়ী করা হচ্ছে। তাও ভালো রাষ্ট্র ভুল বুঝতে পেরে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হাওরের উপর দিয়ে আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না।
প্রকৃতির জন্য কোনো দুঃখবোধ তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ প্রকৃতির এক অপরূপ অলংকার, এই অহং আর আমাদের নেই। সুন্দরবন থেকে শুরু করে সারাদেশের বনভূমি আজ দখলের নখের কবলে। পুকুর, জলাভূমি, নদী খুন হচ্ছে একের পর এক।
নগরায়ন বা সস্তা আনন্দ খুঁজতে গিয়ে আমরা প্রকৃতির দুঃখ বাড়াচ্ছি। উন্নয়ন কাকে বলে, প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়ন স্বাক্ষরতা না থাকায়, কোনো কোনো উন্নয়ন আমাদেরই দুঃখের কারণ কিংবা জীবন বিপন্ন হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাওরের অকাল বন্যা, বাঁধ ভাঙা পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার জন্য এমন শিশুসুলভ অবকাঠামো নির্মাণকে দায়ী করা হচ্ছে। তাও ভালো রাষ্ট্র ভুল বুঝতে পেরে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হাওরের উপর দিয়ে আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না।
আমরা গত বছর চারেক ধরে দেখতে পাচ্ছি, ইটনা- মিঠামইনের হাওরের উপর দিয়ে তৈরি অলওয়েদার সড়কটি নতুন পর্যটন এলাকায় পরিণত হয়েছে।
সারাদেশ থেকে মানুষ ঐ সড়কে ছুটে যাচ্ছে। বাহ্যিকভাবে বিশাল জলরাশির বুক চিড়ে যাওয়া সড়কটি রূপবান। কিন্তু তার রূপের আড়ালে রয়েছে হাওরের কান্না। কারণ সড়কটি হাওরে জল প্রবাহের স্বাভাবিকতায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এবারে উদাহরণ যদি দেই—গত ২০ দিনে ২১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে প্রতিবেশী ভারতের চেরাপুঞ্জিতে। চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা পানি যত সহজে বৌলাই ও ধনু নদী হয়ে ভৈরবে মেঘনায় এসে নামতো, সেটি এখন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কের জন্য পাড়ছে না। ঢলে নেমে আসা ৪ হাজার কিউসেক মিটার পানির মাত্র এক হাজার পৌঁছাতে পারছে মেঘনায়। বাকি জল চলে যাচ্ছে সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে।
হাওরের ফসলি মাঠে ঢলের পানি ঢুকে পড়ার কারণ ছিল দুর্বল বাঁধ। যতটা পুষ্ট করে বাঁধ তৈরির প্রয়োজন ছিল সেটা হয়নি। একদম নদী ঘেঁষে বাঁধ তৈরি হওয়াতে, বাঁধের মাটি হাওরে চলে এসে নাব্য কমিয়েছে।
হাওরের জল প্রবাহের এই সংকট নতুন। কিন্তু দুই যুগ আগেও আগাম বন্যায়, ঢলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনার ফসল তলিয়ে যাওয়ার খবর সংগ্রহ করতে আমি ছুটে গিয়েছি ঢাকা থেকে ক্যামেরা নিয়ে। তখন হাওরের ফসলি মাঠে ঢলের পানি ঢুকে পড়ার কারণ ছিল দুর্বল বাঁধ।
যতটা পুষ্ট করে বাঁধ তৈরির প্রয়োজন ছিল সেটা হয়নি। একদম নদী ঘেঁষে বাঁধ তৈরি হওয়াতে, বাঁধের মাটি হাওরে চলে এসে নাব্য কমিয়েছে। পাশাপাশি বাঁধের ওপর দিয়ে মানুষ ও বাহন চলাচলের কারণে যে বাঁধের ক্ষতি হয় প্রতিনিয়ত, সেই ক্ষতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে অনিয়ম।
হাওর উন্নয়নে কমিটি ও পরিষদের অন্ত নেই। মৌসুমি অবস্থায় সরবও দেখা যায় এদের। কিন্তু সবই অনুদান ও রাজনৈতিক আনুকূল্যের কৃত্রিম শ্বাস, প্রশ্বাসের মতো। যদি প্রকৃত অর্থেই সংগঠনগুলো হাওর দরদী হতো, তাহলে হাওরে নগরের ফোটা দেওয়া, কৃত্রিম ও পরিকল্পিত উন্নয়নের সহজ বিস্তার ঘটতো না।
হাওরের মৌসুমি পর্যটন বা উল্লাসের চেয়ে কৃষি, কৃষক অগ্রাধিকার পেত। ফসল রক্ষার জন্যে কৃষকের উদ্বেগ, ফসল হারানোর কান্না প্রতিবার গণমাধ্যমের প্রধান খবর হয়ে উঠতো না।
অবশ্য আমরা তো এও জানি না, বাঁধ ভেঙে ঢলের পানি নেমে আসা তীব্রতা, স্বচ্ছ জলের নিচে তলিয়ে থাকা সবুজ ফসলের মাঝেও আমরা সৌন্দর্য দেখতে পাই হয়তো। তাই উপভোগের উপলক্ষ জিইয়ে রাখছি!
কৃষকের আহাজারির মাঝে কোনো লোকজ সুর লুকিয়ে আছে কি না জানি না। তবে আমি বছরের পর বছর হাওয়ার এলাকার মানুষের নিঃস্ব হওয়া দেখেছি। ফসল ডুবেছে জলে। আর কৃষককে ডুবতে দেখেছি ঋণে, সুদে। হাওর বাঁচানোর সেমিনার, প্রস্তাবনা এবং নীতি কৃষকের মুখে হাসিকে দীর্ঘজীবী করতে পারেনি। এখানেই আমাদের নাগরিক হয়ে উঠা সভ্যতার পরাজয়।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী