নৈরাজ্যের শেষ কোথায়?
ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সাথে কলেজ ঘেঁষে গড়ে ওঠা নিউ মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড ও অন্যান্য মার্কেটের দোকান কর্মচারী ও হকারদের মধ্যে লড়াই ঐতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে।
দোকানে দোকানে চাঁদাবাজি করা, কোনো জামা কাপড় পছন্দ হলে দাম না নিয়ে তুলে আনা, দোকানে ফাও খাওয়া তো আছেই, আছে চাঁদার জন্য ব্যবসায়ীকে এনে হোস্টেলে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনাও। এ নিয়ে সংঘর্ষ লেগেই থাকে এবং এসব সংঘর্ষ মাঝে মাঝেই ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠে, যেমন রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠেছিল ১৯ এপ্রিল। একজন দরিদ্র নিরীহ পথচারীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রশ্ন উঠল – এ নৈরাজ্যের শেষ কোথায়?
বিজ্ঞাপন
ঢাকা কলেজ দেশের সেরা কলেজ। এসএসসিতে যারা খুব ভালো ফল করে, তারাই এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। স্নাতক পর্যায়েও যাচাই-বাছাই করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কীভাবে এসব অপকর্ম করে?
এত পুরনো কলেজ, এত এত প্রথিতযশা ছাত্র বেরিয়েছে এখান থেকে, এই কলেজের দেয়ালে দেয়ালে জড়িয়ে রয়েছে সেইসব ছাত্রদের অনেক স্মৃতি। হোস্টেলের যে ঘরগুলো ছিল তাদের স্বর্গ, সেসবের অনেকগুলোতে এখন বাস করে সমাজ বিরোধীরা!
পুলিশ দেরিতে এসেছিল। আবার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে এত দীর্ঘ সময় লাগল কেন, তা নিয়েও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পুলিশ সময়মতো ঘটনাস্থলে এলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না বলেই মনে করছে সব পক্ষ। এমনকি খোদ শিক্ষামন্ত্রীও এ কথা বলেছেন।
তবে ১৯ এপ্রিলের সংঘর্ষ, যা আগের রাতে শুরু হয়েছিল, তা চাঁদাবাজি সম্পর্কিত নয় বলেই আপাতত সব পক্ষ বলছে। নিউমার্কেটের একটি খাবারের দোকানের কর্মীদের নিজেদের মধ্যকার বচসায় এক পর্যায়ে এক পক্ষের হয়ে দোকানিদের সঙ্গে তর্ক হয় ঢাকা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর। এর জের ধরে ১৮ এপ্রিল গভীর রাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও দোকানিদের সংঘর্ষ হয়। তাতে কয়েকজন আহতও হন।
পুলিশ আসে, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। সংঘর্ষ রাত আড়াইটা পর্যন্ত গড়ায়। সেহরির সময় ঘনিয়ে আসায় দুই পক্ষ যখন রণে ক্ষান্ত দেয়, তখন পুলিশও চলে যায়। কিন্তু রাতের এই সংঘর্ষ সেখানেই শেষ হয়নি। এর জেরে ১৯ এপ্রিল সকাল ১০টার পর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় জড়ো হন মানববন্ধনের জন্য।
এ সময় নিউ মার্কেটসহ আশপাশের কয়েকটি মার্কেটের দোকানিরা বেরিয়ে এলে আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। দফায় দফায় সংঘর্ষে বন্ধ হয়ে যায় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মিরপুর সড়ক। শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। যানজট ছড়িয়ে যায় পুরো শহরে। আক্রান্ত হয় অসংখ্য সাংবাদিক, এ্যাম্বুলেন্স এবং পথচারী যার জেরে একজন মারাও যায়।
আগের রাতের ঘটনা, পরদিন এতদূর গড়াল কেন, সেই উত্তর খোঁজা এখন জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, স্থানীয় এমপি বা তার প্রতিনিধি, ওয়ার্ড কমিশনার, ব্যবসায়ী কিংবা ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয় —বিরোধ থামাতে কারও কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না কেন?
প্রচণ্ড গরম, অসহনীয় যানজট উপেক্ষা করে নগরের মানুষ রাস্তায় নামে নানা প্রয়োজনে। চলছে পবিত্র রমজান, সামনে পবিত্র ঈদুল ফিতর। কেনাকাটায় ব্যস্ত শহরের বাসিন্দারা। ব্যবসায়ীরাও বছরের বড় এ আয়োজন ঘিরে ব্যস্ত। এমন এক সময়ে এই নাগরিক যন্ত্রণার সৃষ্টি হলো যা চলল গভীর রাত পর্যন্ত!
পুলিশ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে গুলি করেছে। এর তদন্ত হওয়া উচিত। ফুটেজ দেখে দেখে সাংবাদিক ও হাসপাতালের গাড়ি আক্রমণকারীদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করাও জরুরি।
বড় প্রশ্ন উঠছে পুলিশে ভূমিকা নিয়েও। সকাল দশটায় ঘটনা শুরু, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এলো সংঘর্ষ শুরুর প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর। ততক্ষণে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ইট ও লাঠির আঘাতে আহত হয়েছেন সাংবাদিক, পথচারী, ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ অন্তত ৪০ জন।
পুলিশ দেরিতে এসেছিল। আবার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে এত দীর্ঘ সময় লাগল কেন, তা নিয়েও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পুলিশ সময়মতো ঘটনাস্থলে এলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না বলেই মনে করছে সব পক্ষ। এমনকি খোদ শিক্ষামন্ত্রীও এ কথা বলেছেন।
একটা বড় অভিযোগ উঠেছে যে, পুলিশ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে গুলি করেছে। এর তদন্ত হওয়া উচিত। ফুটেজ দেখে দেখে সাংবাদিক ও হাসপাতালের গাড়ি আক্রমণকারীদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করাও জরুরি।
শিক্ষাঙ্গনকে কলুষমুক্ত করবেন, নৈরাজ্য মুছে দেবেন—এমন প্রতিশ্রুতি দেন আমাদের রাজনীতিকরা। কিন্তু কলুষ মুক্তি অনেক দূরের কথা, নৈরাজ্যের কোলাহল রোজ বাড়তে দেখছি আমরা। ১৯ এপ্রিল ঢাকা কলেজ ও হকারদের মধ্যকার সংঘর্ষের যে ছবি উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং ভীতিকর।
নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা যে শুধু ঢাকা কলেজ এলাকায় সীমাবদ্ধ তা নয়, সারাদেশেই একের পর এক ক্যাম্পাস থেকেও নৈরাজ্যের ছবি উঠে আসে। নানা সতর্কবার্তা, হুঁশিয়ারি, তর্জন— কোনোকিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দিচ্ছেই।
বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্যের জেরে নিয়মিত সংবাদ শিরোনামে থাকছে কোনো না কোনো ক্যাম্পাস। কোথাও শিক্ষার্থীদের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়ে উঠছে ক্যাম্পাস, কোথাও শিক্ষকদের চরম হেনস্থার মুখে ফেলা হচ্ছে, কোথাও নারী নির্যাতন সংশ্লিষ্ট ঘটনা। আর চাঁদাবাজির ঘটনা তো নিয়মিত। প্রত্যেকটি ছবিই সমপরিমাণ লজ্জাজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক।
ছাত্র সংগঠন আছে, ছাত্র রাজনীতি নেই, নেই ছাত্র সংসদ। ফলে কোনো সুস্থতা নেই। এ কারণেই শিক্ষাক্ষেত্রে ধারাবাহিক অশান্ত পরিস্থিতির ভূমিকা দেখছি আমরা। এই সংকট থেকে মুক্তি মিলবে কবে?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি