ঘুরে দাঁড়াবার নববর্ষ
বাংলা নববর্ষকে ঘিরে সব উদযাপনের মূল কথা বাঙালির আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান এবং অসাম্প্রদায়িকতার মর্মবাণী তুলে ধরা। আগের দুটি নববর্ষ আমরা করোনা মহামারির কারণে সেভাবে উদযাপন করতে পারিনি। তাই এবারের নববর্ষ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ-একথা মানতেই হবে।
এ বছর আবার বর্ষবরণ হবে রমনা বটমূলে। গত দু’বছর ধরেই আমরা ঘরবন্দী ছিলাম। সেই সময়টায় বিশ্বব্যাপী নেমে এসেছিল ‘মানবিক-সামাজিক-মানসিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়।’ সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আলোর পথে হাঁটতে এবারে বাঙালি সমবেত হতে চাইছে নববর্ষে রমনার বটমূলে। শত দুঃখ সত্ত্বেও নিশ্চয় এবারের নববর্ষে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই যুক্ত হবেন এই আনন্দযজ্ঞে। নব আনন্দে জাগবে মানুষ।
বিজ্ঞাপন
নিঃসন্দেহে আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে পয়লা বৈশাখ বরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু সেই ইতিহাস আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। এর শুরুটা এমন এক সময়ে হয়েছিল যখন নিজেদের বাঙালি হিসেবে দাবি করাটাই সাহসের কাজ ছিল।
১৯৬১ সালে একদিকে পাকিস্তান আমলের দমবন্ধ পরিবেশ, আর অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলনের মধ্যেই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ। স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী পাকিস্তান সরকার অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে এই উদযাপনের ওপর।
এর প্রতিবাদে গণমুখী আঙ্গিকে সুর ও সঙ্গীতকে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), আহমেদুর রহমান (‘ভিমরুল’)-সহ আরও অনেকেই সম্মিলিত উদ্যোগ নেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ছায়ানট।
মূলত ছায়ানট সংগঠকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক, হাইকোর্টের বিচারপতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুণীজনেরা ঐক্যবদ্ধভাবে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে এগিয়ে আসেন। ‘আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবই’ বলে সেদিন জোর সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
একই সঙ্গে তিনি নজরুলকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপনেরও বিরুদ্ধে ছিলেন। সেই কারণেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ মিলেমিশে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পোক্ত করা সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানি সেই আঁধার যুগেও।
১৯৬১ সালে একদিকে পাকিস্তান আমলের দমবন্ধ পরিবেশ, আর অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলনের মধ্যেই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ।
তবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার ধারা বিবরণী ঠিক সেভাবে আমাদের সন্তানদের বলে উঠতে পারিনি আমরা। তাই বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন নির্মাণের রাজনৈতিক যুদ্ধের ভিত গড়তে, সংস্কৃতি কর্মীরা, বিশেষ করে ‘ছায়ানট’ সংগঠক ও কর্মীদের অবিস্মরণীয় ভূমিকা আজকের তরুণ প্রজন্মকে জানানোর প্রয়োজন রয়েছে।
সুর দিয়ে মানুষের মনের গভীরতর স্বপ্নকে প্রভাবিত করার এই প্রচেষ্টাকে আরও সক্রিয় করার অভিপ্রায়েই ১৯৬৭ সালে রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন ছায়ানট সংগঠকরা। প্রয়াত ড. নওয়াজেশ আহমদ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক একজন বিজ্ঞানী।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক স্মারক বক্তৃতায় (২০০৭) তিনি বলেছিলেন, কীভাবে রমনা বটমূলের পয়লা বৈশাখের সূত্রপাত হয়। সন্জীদা আপার মুখেও একথা বহুবার শুনেছি। ড. নওয়াজেশ সেদিন বলেন, “১৯৬৭ সনে ওয়াহিদুল এবং সন্জীদা আমাকে বলল, ‘এবার আমরা বাংলা নববর্ষ বাইরে করব। তুমি একটা গাছ দ্যাখো।’ আমার উপর ভার দিল ওয়াহিদুল। আমি ওয়াহিদুলকে রমনা বটমূলের কথা বললাম।”
স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। রমনা বটমূলের এই নববর্ষ উদযাপন এখন সারা দেশ এবং বাঙালি অধ্যুষিত বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাংলা নববর্ষে পথে নেমে পড়ে। নতুন জামাকাপড় পরে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি বাঙালির অস্তিত্বের জানান দেয়। পাশাপাশি চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধারণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব সাংস্কৃতিক আয়োজন। তাই করোনা-পরবর্তীকালে বাংলা নববর্ষের পুরোদমে উদযাপন নিশ্চয়ই আবারও আমাদের সাহস জোগাবে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এগোনোর জন্য।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, নববর্ষের এই উদযাপনের সাংস্কৃতিক গুরুত্বের পাশাপাশি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। ভেবে দেখুন, এই সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উদযাপনকে কেন্দ্র করে করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় ঝিমিয়ে পড়া খাতগুলোতে গতি সঞ্চার হলে তা পুরো অর্থনীতির জন্য কতোটা ইতিবাচক হতে পারে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধারণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব সাংস্কৃতিক আয়োজন। তাই করোনা-পরবর্তীকালে বাংলা নববর্ষের পুরোদমে উদযাপন নিশ্চয়ই আবারও আমাদের সাহস জোগাবে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এগোনোর জন্য।
মধ্য ও উচ্চবিত্তের কথা না হয় নাইবা বললাম, শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ যারা, ধরা যাক গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা, তারা সকলেই যদি পরিবারের জন্য নববর্ষ উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা করেন তাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। গ্রামেও তো এখন সেবাখাতের ব্যাপ্তি বিরাট।
গ্রামীণ আয়ের ষাট শতাংশই আসছে অ-কৃষি খাত থেকে। কাজেই নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামের অ-কৃষি খাতের উদ্যোক্তারাও বাড়তি বেচাকেনার মুখ দেখবেন। দেশব্যাপী টাকার এই লেনদেনের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মীদেরও আয়-রোজগার বাড়বে। তাদের জন্য নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির চাপ মোকাবিলা কিছুটা হলেও সহজতর তো হবেই। করোনার দুর্দশা কাটিয়ে দুই বছর বাদে পুরো মাত্রায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন অর্থনীতির জন্য সুখবরই বটে।
দশ-পনেরো বছর আগেও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক কেনা এত বেশি ছিল না। কিন্তু করোনা আসার আগে ২০১৯ সালের পয়লা বৈশাখকে ঘিরে পনেরো হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্ততকারক মালিক সমিতি। এই পোশাক কিন্তু কেবল বিপণী বিতানে বিক্রি হয়েছে এমন নয়। বরং ফুটপাথের বিক্রেতাসহ অনানুষ্ঠানিক বিক্রয়কেন্দ্র থেকেও এর একটি বড় অংশ বিক্রি হয়েছে।
২০১৯ সালের আগের হিসাব বলছে, সেই বিক্রির পরিমাণ বছরে গড়ে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। করেনাকালে এই প্রবৃদ্ধি নিশ্চয়ই ধাক্কা খেয়েছে। তবে এবারের নববর্ষে হয়তো আমরা পুরোপুরি আগের ধারায় না ফিরলেও গত দুই বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পোশাক এবং ভোগ্যপণ্য বিক্রি বাড়তে দেখব।
এবারের বাংলা নববর্ষের সপ্তাহ দুয়েক পরই আবার ঈদুল ফিতর। কাজেই বলা যায়, চলতি এপ্রিল মাসের পুরো দ্বিতীয়ার্ধ জুড়েই বাজার সরগরম থাকবে। ঈদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুফলও পৌঁছে যাবে সকল স্তরে।
আমাদের ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তারা দুটো উৎসবের চাহিদা মাথায় রেখেই পণ্য সরবরাহের প্রস্তুতি নিয়েছেন। ফলে অর্থনীতির গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এই দুটি সপ্তাহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে—এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর