বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির নিয়ে আমাদের তৃপ্তি যথেষ্ট এবং তা যুক্তিসঙ্গত বটে। কারণ ২০০৭-২০০৮ সালে সারা দুনিয়া জোড়া যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঝড় বয়ে গেল বাংলাদেশ কিন্তু ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছিল। আবার ২০১৫ এর শেষে এসে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেল, মুষ্টিমেয় যে ক’টি দরিদ্র দেশ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আবার ২০১৪ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের মাপকাঠিতে ‘নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশ’ বলে পরিগণিত হয়েছে‌। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ২০১৮ এ বাংলাদেশ জাতিসংঘের মাপকাঠিতে ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হওয়ার পথে প্রথম ধাপের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এই ধারাবাহিকতায় সব ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ দরিদ্র দেশের নাম ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। উন্নয়নের এই মাপকাঠিতে আরও একটি উল্লেখযোগ্য সূচক হল মাথাপিছু আয়।  যেখানে ২০০৮ সালেও বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল সাড়ে ৬৩৫ ডলার, তা ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২০৯৪ ডলারে।

অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে আমরা তৃপ্তি এবং অহংকার বোধ করতেই পারি। কিন্তু উন্নয়নের এই উজ্জ্বল অগ্রযাত্রা কতটা শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সেটা বুঝতে পারা এবং সেখানে দুর্বলতা কোথাও থাকলে তা কাটিয়ে ওঠা জরুরি। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে অর্থনৈতিক সক্ষমতা যদি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে উন্নয়নের সুফল সকলের কাছে সমানভাবে পৌঁছায় না, আর দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্য বিমোচনের মূল লক্ষ্য অবহেলিত থাকে আর ভারসাম্যহীন উন্নয়ন যেকোনো সময় যেকোনো অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক বিপর্যয় এর সূত্রপাত ঘটাতে পারে। তাই মোটা দাগে জিডিপির প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে সামষ্টিক অর্থনীতির নানা দিকে সক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতি দরকার। ২০২০ সালে করোনা মহামারির প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে এই ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের বিষয়টি ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারায় মূলত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেবা আর শিল্পখাতের; আর কৃষিখাতের অবদান জিডিপিতে কমছে। উন্নয়ন অর্থনীতি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রবণতা অত্যন্ত স্বাভাবিক। জিডিপির অংশ হিসেবে কৃষিখাতের সংকোচন হলেও শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি ঘটছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে কৃষি ছাড়া আমাদের চলবে না। করোনার মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় বাংলাদেশকে খাদ্য নিয়ে ভাবতে হয়নি কারণ আমাদের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় মৌলিক কৃষি পণ্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে আমরা বিভিন্ন সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের দামে হঠাৎ ওঠানামা দেখি। বিশেষ করে চাল, পেঁয়াজ-এই সকল পণ্যের হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা জনজীবনে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। এই সকল নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য দরিদ্র মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে পণ্যের উৎপাদন ও মজুদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন এবং সে অনুযায়ী স্বল্পমূল্যে দরিদ্র মানুষের কাছে পণ্য বিক্রয়ের উদ্যোগ, পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক রাখা, যথাসময়ে আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি বিশেষ প্রয়োজন। তাছাড়া যে সকল পণ্যের জোগান নির্ভর করে আমদানির ওপর, সে সব পণ্যের আমদানির উৎস বাজারে কি অবস্থা তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা দরকার। যেমন পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আগস্ট মাসের পর থেকেই দাম বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, কারণ তখন দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যায়। এই সময়ে পেঁয়াজের প্রধান আমদানি বাজার ভারতে কোনো সমস্যা হলে তার প্রভাব বাংলাদেশের পেঁয়াজের মূল্যের উপর পড়ে। তাই এই সময়ে ভারতের পেঁয়াজের উৎপাদন মূল্য ইত্যাদি নিয়মিত নজর রাখতে হবে যাতে তাদের কোনো সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের দেশের পেঁয়াজের দামে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি না হয়। ঠিক একইভাবে বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে চালের দামের উপর প্রভাব না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।

দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্য বিমোচনের মূল লক্ষ্য অবহেলিত থাকে আর ভারসাম্যহীন উন্নয়ন যেকোনো সময় যেকোনো অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক বিপর্যয় এর সূত্রপাত ঘটাতে পারে।

যেহেতু কৃষিভূমি দিন দিন কমে যাচ্ছে তাই কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এখন আমাদের খাদ্যের জোগান ঠিক রাখার উপায় । তাই কৃষিতে গবেষণা এবং নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার ও ব্যবহারে সরকারি সমর্থন দরকার। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষির উৎপাদনশীলতা যেভাবে হুমকির মুখে পড়ছে সে বিষয়েও প্রস্তুতি দরকার।

বাংলাদেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ক্রমাগত বাড়ছে এবং তা বর্তমানে ৩৫.৩৬ ভাগ। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের অবদান ২৪ ভাগ। এই খাতে নতুন ধরনের শিল্পের যেমন আবির্ভাব ঘটছে তেমনি বছরের পর বছর লোকসানে পড়ে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানা চালু রয়েছে। শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সাপেক্ষে এই সকল লোকসানই শিল্প-কারখানা বেসরকারি খাতে স্থানান্তর কিংবা এইসব শিল্প-কারখানার এলাকা অর্থনৈতিক জোন রূপান্তরিত করে সেখানে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের নিয়োগের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বয়স্ক অনেক শ্রমিক হয়তো নতুন কৌশল আয়ত্ত করতে পারবেন না। কিন্তু অন্যদেরকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনরায় কর্মসংস্থানে আনা সম্ভব হবে। বছরের পর বছর রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের লোকসান সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভিতকে দুর্বল করে।

আবার রপ্তানি মুখী শিল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে তৈরি পোশাক ছাড়া তেমন কোনো শিল্প বড় আকারে রপ্তানিতে যেতে পারেনি। কাজেই শিল্পক্ষেত্রে নতুন ধরনের শিল্পকে উৎসাহ প্রদান দরকার। সম্প্রতি করোনার প্রভাবে অনেক খাত যেমন সমস্যায় পড়েছে আবার অনেক খাতে সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, মোবাইল আর্থিক লেনদেন ভিত্তিক বিভিন্ন খাত, অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদির প্রসার ঘটছে। ভার্চুয়াল বাজারের উদ্ভব হয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-উপাদান এক নতুন ধরনের মাত্রা পাচ্ছে, গড়ে উঠছে অনেক সার্ভিস খাত। অনেক ছোট ছোট উদ্যোগ গড়ে উঠছে যা সংযুক্ত হচ্ছে এই ভার্চুয়াল বাজারে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়াতে হলে পরিবেশবান্ধব উদ্যোক্তা হতে হবে। কেবলমাত্র ব্যাংকের ঋণের সুদের হার কমিয়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা যাবে না, বরং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সহযোগিতায় এসএমই ফাউন্ডেশন কিংবা বিসিকের কার্যপরিধি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিও থাকতে হবে। ক্লাস্টার ভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেখানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস জোরদার করতে হবে যাতে এসব শিল্পের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হয়।

দরিদ্র পরিবারের সন্তান যদি ভালো মানের শিক্ষা এবং ভালো স্বাস্থ্যের সুযোগ লাভ করে তাহলে তারাও সংযুক্ত হতে পারবে বেশি আয়ের শ্রমবাজারে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নের শিক্ষা দিতে হবে।

আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় দুর্বল জায়গা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য তা এখন জোরেশোরে সামনে এসেছে। এই আয় বৈষম্য দূর করতে হলে দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে তাদের ভাগ্য বদলানোর চাবি। আর সেই চাবি হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ তৈরি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান যদি ভালো মানের শিক্ষা এবং ভালো স্বাস্থ্যের সুযোগ লাভ করে তাহলে তারাও সংযুক্ত হতে পারবে বেশি আয়ের শ্রমবাজারে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নের শিক্ষা দিতে হবে। এ দেশে এখন যে ধরনের শিল্পের বিকাশ ঘটছে,  সেই শিল্পের প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি করতে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে দক্ষতা উন্নয়ন কোর্স সংযুক্ত করতে হবে। তাছাড়া স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনশক্তি গড়ে তোলা যায়।

অর্থনৈতিক সক্ষমতায় একটি সূচক প্রবৃদ্ধি কিন্তু প্রবৃদ্ধি হওয়া মানেই অর্থনীতি সকলের জন্য কল্যাণকর জীবন নিশ্চিত করার সক্ষমতা অর্জন করেছে তা কিন্তু নয়। প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে যে আয় যুক্ত হচ্ছে তাতে সকলের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সব মানুষের সংযোগ ঘটাতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন আর সেই সাথে বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। করোনা অতিমারি বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু এও দেখিয়েছে যে, আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি খুব দুর্বল নয়। তবে এই অর্থনীতিতে দরিদ্র মানুষের অগ্রগতির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি এখনো কাজে লাগানো যায়নি। বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান দুর্বলতা কাটিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গেলে এদেশ থেকে দারিদ্র্য নিশ্চয়ই দূর হবে।

ড. নাজনীন আহমেদ ।। সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)

nazneen7ahmed@yahoo.com