শ্রীলঙ্কার পরিস্থতি থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নিতে হবে
শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। বর্তমানে চরম এক সংকটকাল অতিক্রম করছে দেশটি। চারিদিকে এখন শুধু হাহাকার। জ্বালানী তেল এবং খাদ্য কেনার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সাধারণ মানুষ। সমাধান যেন হাতের নাগালের বাহিরে। ৫০০ টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না এক কেজি চাল। এই চরম অবস্থায় মানুষ বিক্ষোভ এবং অবরোধ করছে । প্রতিহিংসা ছড়িয়ে পড়ছে চারিপাশে। সরকারের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করছে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছাড়া মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্য গত রোববার রাতে এক বৈঠকের পর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ঠেকাতে দেশটিতে গত শনিবার থেকে ৩৬ ঘণ্টার কারফিউ চলছে। কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। খাদ্যে উদ্বৃত্ত একটি দেশ কেন হঠাৎ করে চরম খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত হলো এবং এর পিছনের কারণ কী !
প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ২০১৯ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। সে জন্য কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। বন্ধ করা হয় সার আমদানি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কৃষিক্ষেত্রে এবং চালের উৎপাদন ২০ শতাংশের অধিক কমে যায়। একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করে। আমদানি সত্ত্বেও চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে যায়। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
বিজ্ঞাপন
পাশাপাশি অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশটির চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে। চা রপ্তানি করে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সেখানেও বড় ধাক্কা লাগে। কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে আনার জন্য সরকার ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। তারপরও দেশজুড়ে খাদ্যঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করে। অর্গানিক কৃষি চালু করার আগে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হয়নি। এতে দেশে উল্টো ফল হয়েছে। বিশেষ করে চাল উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্রামের কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং খাদ্য আমদানি করার জন্য আরও বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করেও সামাল দিতে শ্রীলঙ্কার সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় যে, মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় অনেক শ্রীলঙ্কান, যাদের সামর্থ্য আছে, বিদেশে উন্নত জীবনের আশায় নিজ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন বলে রিপোর্ট হচ্ছে। যাদের দেশ ছাড়ার সামর্থ্য নেই, তারা এখন মূল পেশার বাইরে অন্যকিছু করতে বাধ্য হচ্ছে। নয়তো মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিশ্ব মিডিয়ায় সেদেশের মানুষের ভয়াবহ দুর্ভোগ উঠে আসছে।
বাংলাদেশকেও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে। যেকোনো মূল্যে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাল উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। চালের উৎপাদনকে সরকারের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে প্রাধান্য দিতে হবে। করোনার অভিঘাতে বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। টাকার বিনিময়েও খাদ্য সংগ্রহ করা সহজ ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে কোভিড অতিমারির ভয়াবহ পরিস্থিতি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। এই সফলতার প্রধান ও অন্যতম কারণ হচ্ছে কৃষি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী এবং কৃষি মন্ত্রীর গৃহীত যুগপৎ সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও নির্দেশনা এবং টেকসই খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার অব্যাহত সফলতা।
ঢাকায় সম্প্রতি শেষ হওয়া ৩৬তম এশিয়া প্যাসিফিক আঞ্চলিক সম্মেলনে (এপিআরসি) অংশ নিতে আসা এফএওর মহাপরিচালক চু দোয়াংয়ু কোভিড অতিমারির ভয়াবহ পরিস্থিতি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে আমরা যদি বিজ্ঞান চর্চায় উন্নতি না করি আমাদের ভবিষ্যৎ বিশ্ব আরও ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। কেবলমাত্র বিজ্ঞানেই রয়েছে ভবিষ্যৎ সমস্যার সমাধান, এর কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ যদি উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে চায় তাহলে হাত-মাথা (Hand-Head) দুটোকেই একসঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পনাহীনভাবে কাজ করলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। যেটি ঘটেছে শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে। তাই, বিজ্ঞানভিত্তিক-উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেওয়া এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি ভিত্তিক খাদ্য রূপান্তর ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে।
বর্তমান সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনায় বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, বিগত ৫০ বছরে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। ২০২০-২১ সালে দেশে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৩.৮৭ কোটি মেট্রিক টন । তথ্য মতে দেশের ১৬৯.১ মিলিয়ন মানুষের চাহিদা পূরণ করার পরেও ৩.৪৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকার কথা। যেকোনো মূল্যায়নে বাংলাদেশের এই অবস্থান প্রশংসার দাবি রাখে। কৃষির এই অভূতপূর্ব সাফল্য অনেক দেশের কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। কৃষির এই উন্নয়নের ভিত্তিই হচ্ছে গবেষণায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের উৎকর্ষতা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বক্ষণিক সহযোগীতা, বিএডিসি পুনর্গঠন, উপকরণ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, কৃষি খাতে সরকারী ও প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ এবং সর্বোপরি কৃষি উন্নয়নে যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও হালনাগাদকরণের সামগ্রিক প্রভাবে সর্বক্ষেত্রে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়ে ‘খোরপোষের কৃষি’ আজ ‘বাণিজ্যিক কৃষি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কৃষি রূপান্তর অভাবনীয়। ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে দেশে চালের উৎপাদন ছিল এক কোটি টনের নিচে যা বর্তমানে ৩.৮৭ কোটি টন। যার ফলে আজ আমরা বাণিজ্যিক কৃষির কথা ভাবতে পারছি। অর্থনৈতিক গতিশীলতার জন্য কৃষি উন্নয়নের এই ধারাকে আরও বেগবান করা অপরিহার্য।
আমাদের কৃষি জমি, কৃষিতে শ্রমশক্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ কমছে অন্যদিকে বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তন লক্ষণীয় তথাপি কৃষির উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭১-৭২ সালে ১৪৩ শতাংশ হতে বর্তমানে ১৯৪ শতাংশ।
১৯৭১-৭২ সালে এক, দুই এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ ছিল ৫.০৯, ২.৭৮ এবং ০.৩৮ মিলিয়ন হেক্টর। কৃষিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের সংযোজন, ফসলের সংক্ষিপ্ত সময়কাল, সেচ অবকাঠামো উন্নয়ন, উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনা, যান্ত্রিকীকরণ এবং সম্প্রসারণ পরিষেবা বৃদ্ধি, আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি এবং কৃষক বান্ধব নীতির কারণে এক ফসলি জমি হ্রাস পেয়ে দুই ও তিন ফসলি জমি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কৃষিতে যোগ হয়েছে চার ফসলি জমি। বর্তমানে এক, দুই, তিন এবং চার ফসলি জমির পরিমাণ যথাক্রমে ২.২৫, ৩.৯১, ১.৭৬ এবং ০.০২ মিলিয়ন হেক্টর।
একমাত্র উন্নত ফসল ধারার প্রবর্তনের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা সর্বোচ্চ বাড়ানো সম্ভব। ধান ভিত্তিক ফসল ধারায় স্বল্পমেয়াদী অন্য ফসল সমন্বয় করে ফসলের নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে ধানের আবাদ এবং ফলনকে কোনভাবেই সংকোচিত করে না। তিন এবং চার ফসলি চাষের প্রবর্তনের জন্য ধানের ফলনের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে স্বল্পমেয়াদী ধানের আবাদ কাম্য হতে পারে না। আজকাল প্রায়শই স্বল্প মেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন এবং কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে অন্য ফসল শস্যক্রমে সংযোগের কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ফসলের জীবনকালের সঙ্গে ফলনের একটি সরাসরি সম্পর্ক আছে। একটি নির্দিষ্ট সীমার পরে ধানের ফলন কম্প্রোমাইজ করতে হবে যা কোন ভাবেই ঠিক হবে না। যদি ধানের ফলনকে কম্প্রোমাইজ করে অধিক স্বল্প মেয়াদি জাত উদ্ভাবন এবং স্বল্প মেয়াদি জাতের আবাদ ব্যাপকভিত্তিক সম্প্রসারণ করা হয় তাহলে ধানের মোট উৎপাদন বিঘ্নিত হতে পারে।
তাছাড়া দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন অজুহাত যেমন- গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদি দেখিয়ে ধানের আবাদ সংকোচিত করার জন্য বিভিন্ন মহল কাজ করছে। এমনকি নতুন নতুন শস্যক্রম সংযোজনের নামে ধানের আবাদকে সংকোচিত করার বিষয়টি দৃশ্যমান। এ ব্যাপারে সবাইকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে। বরং ধান উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মিলরেখে ধানের আবাদ এলাকা সম্প্রসারণ বিশেষ করে পতিত জমি চাষের আওতায় আনা, ফলনোত্তর অপচয় হ্রাস এবং আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন অব্যাহত রাখতে হবে।
ধান উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ধান ভিত্তিক গবেষণা আধুনিকায়ন, সেচ এলাকা সম্প্রসারণ এবং টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আরও বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। ধান উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে শর্তহীন সহযোগীতা এবং এই উৎপাদন ব্যবস্থা ঠিক রেখে অন্যান্য কার্যক্রম নিতে হবে।
শ্রীলঙ্কার সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে যেখানে এত বড় বিপর্যয় সেখানে আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের আছে একজন প্রধানমন্ত্রী যার দূরদর্শী চিন্তায় কৃষিকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে এই গভীর সংকটকালে সারে ২৮ হাজার কোটি টাকার উপকরণ সহায়তা দিয়ে মোট উৎপাদনকে সঠিক মাত্রায় ধরে রাখার যে প্রচেষ্টা তা অনুকরণীয়।
পরিশেষে বলতে চাই, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রধান খাদ্য যখন চাল, তখন এর উৎপাদন বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোন নেতিবাচক প্রচারণা এবং এর পিছনে কি উদ্দেশ্য ও সুদূরপ্রসারী কি কুফল বয়ে আনতে পারে তা ভেবে দেখতে হবে। নতুবা একটা সময় এসে বাংলাদেশকেও শ্রীলঙ্কার ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। মনে রাখতে হবে চাল শুধু খাদ্যশস্যই নয় বরং চালকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ড. মো. শাহজাহান কবীর ।। মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট